নায়লা বলল, উনার এপার্টমেন্টের এড্রেসটা কি?
অরুনা বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে নায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, উনি আগের ঠিকানাতেই আছেন। তোকে আটকাবার জন্যে মিথ্যা বলেছিলাম।
রাস্তায় এসে অরুনা বলল, তুই ঠিকমত হাঁটতে পর্যন্ত পারছিস না। আয় তো তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আমি একাই যাব।
বাসায় পৌঁছে নায়লার সঙ্গে প্রথম দেখা
বাসায় পৌঁছে নায়লার সঙ্গে প্রথম দেখা হল বাবুর। এই শীতের মধ্যে তার গায়ে পাতলা একটা গেঞ্জি। তার বগলে একটা কুকুরছানা ঘেউ ঘেউ করছে। মানুষের ভালবাসার অত্যাচারের কষ্টে তার জীবন বের হবার জোগাড়।
বাবু বলল, মাম্মাট কুকুল।
নায়লা বিরক্ত গলায় বলল, কুকুর কে দিয়েছে?
ছোটমামা।
ফেলো কুকুর। ফেলো বলছি।
না।
না কিরে বাঁদর ছেলে–ফেলো।
বাবু আকাশ ফাটিয়ে বলল, না। না। ঘর থেকে নুরু বের হয়ে বিরক্ত মুখে বলল, কুকুর ফেলতে বলছিস ক্যান রে আপা? ইন্টারেস্টিং একটা প্রাণী। কত খুঁজে পেতে আনলাম।
তুই যত নোংরামি শিখাচ্ছিস।
আমি পশুপ্রেম শেখাচ্ছি। পুশপ্রেমে নোংরামি কোথায়?
নায়লা বাবুর কোল থেকে কুকুরছানা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাচ্চাটা খানিকক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে আবার রওনা হয়েছে বাবুর দিকে।
নুরু আনন্দের সঙ্গে বলল, মালিক চিনে গেছে। সে চিনে গেছে কে তার প্রভু।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, বাবু, কুকুর ধরবে না।
বাবু ঠিক মার মত গলায় বলল–আমি কুকুল ধলব।
নুরু বলল, গুড বয়। এই ছেলে মামার নাম রাখবে। আপ্য, তুই এরকম আগুন দৃষ্টিতে তাকাবি না। তোর জন্যে গুড নিউজ আছে। তুই বাবুকে তার মত ছেড়ে দে–আমি তার বদলে তোকে গুড নিউজ দিচ্ছি। গুড নিউজ হচ্ছে–তার শাড়ি চলে এসেছে। তাকে এখন শুধু খ্ৰী হানড্রেড এক্সট্রা দিতে হবে।
দরকার নেই আমার শাড়ির।
অবশ্যই দরকার আছে। শাড়িটা একবার হাতে নিয়ে দেখ। ধবধবে শাদা। পরলে মনে হবে আকাশের শাদা মেঘ গায়ে জড়িয়ে রেখেছিস।
শাদা শাড়ি?
এই শাড়িকে শাদা বললে শাদা রঙকে অপমান করা হয়। এই রঙের নাম তুষারশুভ্র।
শাড়ি দেখে নায়লার মন ভাল হয়ে গেল। আশ্চর্য, এত সুন্দর!
নুরু বলল, তোর কি এখনো ধারণা আমি ফটকাবাজ?
নায়লা কিছু বলল না। সে শাড়ি থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। নুরু বলল, আমি ফটকাবাজ না। আসল ফটকাবাজ হচ্ছে আমার দুলাভাই। ফটকাবাজ দি গ্রেট। চাকরি-বাকরি চলে গেছে, কাউকে কিছু বলেনি। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসে আছে।
নায়লা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই এইসব কি বলছিস?
একশ ভাগ খাঁটি কথা বলছি। দুলাভাই দুটা চিঠি পাঠিয়েছে–একটা মার কাছে, একটা তোমার কাছে। মার চিঠিতেই জানা গেল দুলাভাই বরখাস্ত হয়েছেন। তোমাকেও নিশ্চয়ই লিখেছেন। চিঠি পড়ে সব জানতে পারবে। তবে মা যেমন আয়োজন করে কান্নাকাটি শুরু করেছেন–তুমি দয়া করে তা করতে যেও না। শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে আপা?
হুঁ।
তিনশটা টাকা দিয়ে দিও। আছে তো? না কি তুমি পথের ফকিরণী?
নায়লা ভাইকে তিনশ টাকা দিল। মার কাছ থেকে জামানের চিঠি এনে পড়তে শুরু করল। কি সাধারণ সাদামাটা ভঙ্গিতে চিঠি শুরু হয়েছে। কোন প্রিয় সম্বােধন নেই, কিছু নেই-–
নায়লা,
একটা দুঃসংবাদ শুরুতে দিচ্ছি। আমার চাকরি নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই নেই। তোমাকে বলতে পারছিলাম না। বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম বলেই যে বলিনি, তা কিন্তু না। তুমি কষ্ট পাবে সে জন্যেই বলতে পারিনি।
আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু কেন জানি আমার কারণে মানুষ সবচে বেশি কষ্ট পায়। আমার বাবা ছিলেন স্কুলের অংক শিক্ষক। তাঁর মত অংক-জানা লোক গোটা ময়মনসিংহ জেলায় নেই এমন একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল। মেট্রিক পরীক্ষার সময় তিনি কত যত্ন করে যে আমাকে অংক শেখালেন! সেই আমি অংকে ফেল করলাম। অন্যসব সাবজেক্টে ভাল নাম্বার, শুধু অংকে একুশ। প্রথমবার আমি মেট্রিক পাশ করতে পারিনি শুধু অংকের কারণে। রেজাল্ট হবার পর, বাবা সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আর দু মাসের মাথায় বাবার মৃত্যু হল। আমি পরের বছর অংকে লেটার নাম্বার নিয়ে পাশ করলাম। বাবা তা দেখে গেলেন না।
আমার মা সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন–আমি একটা চাকরি করি এটা দেখে যেতে। মা দেখে যেতে পারেননি। তিনি শুধু দেখেছেন আমি পাগলের মত চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি। মা তখন খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। রোজ দুপুরে একবার জিজ্ঞেস করেন, ও খোকন, পিওন কি এসেছে?
আমি বলি, হ্যাঁ।
চাকরির কোন খবর আছে বাবা?
না, কোন খবর নেই।
আমার ফুপু আমাকে বললেন, খোকন, তুই মিথ্যা করে বল চাকরি পেয়েছিস। দেখছিস না তোর মার অবস্থা?
আমি ফুপুকে বললাম, একজন মানুষ মরে যাচ্ছে, তাকে ভুলাবার জুন্যে আমি মিথ্যা কথা বলব না।
ফুপু কঠিন গলায় বললেন, তোর কপালে দুঃখ আছে। তুই মানুষ, তুই নিতান্তই গরু।
ফুপু মাকে গিয়ে বললেন, খুব ভাল সাদ। খোকনের চাকরি হয়েছে। চিঠি এসেছে।
মা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই, কই! চিঠি কই?
ফুপু মার হাতে কি একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। মা পড়তে জানতেন না। সেই তুচ্ছ কাগজ বুকে জড়িয়ে তিনি অনেকক্ষণ। কাঁদলেন–তোর বাবা বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হত? কই খোকন, আমাকে সালাম কর। এত ভাল সংবাদ এসেছে, মাকে সালাম করে দোয়া মিবি না?
আমি মাকে সালাম করলাম না। ভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দিলাম না। ফুপু মাকে বললেন, খোকন লজ্জা পাচ্ছে। সালাম করবে না। তুমি বিনা সালামেই ছেলের জন্যে দোয়া কর।