শাড়ি বদলাবার আগেই বাবু উঠে পড়েছে। বাতিস দুদু, বাতিস দুদু বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। নায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মশারির ভেতর ঢুকল।
মম্মাট, বাতিস দুদু।
দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।
বাবু এক হাত দিয়ে নায়লার চুল টানছে। পা গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে ছোট্ট পুটলির মত হয়ে পড়েছে। তার গা থেকে কি সুন্দর গন্ধ আসছে। আচ্ছা, শিশুদের গা থেকে এক এক সময় যে এক এক রকম গন্ধ আসে তা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?
ঘুমে নায়লার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আধ-ঘুম আধো জাগরণে তার মৃনে হচ্ছে–আহা! বেচারা একা একা বসে আছে।
নায়লাদের বাসাটা ফ্ল্যাটবাড়ি
নায়লাদের বাসাটা ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে যা বোঝায় তা না। ফ্ল্যাটের মালিক শুরুতে ছাদে ড্রাইভারদের থাকার জন্য কিছু ঘর করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, এই ঘরগুলি বেশ ভাল টাকায় ফ্ল্যাটের মালিকরা কিনে নেবেন। বাস্তবে দেখা গেল, ড্রাইভারদের জন্যে ঘর নিতে কেউ আগ্রহী নয়। ফ্ল্যাট-মালিক তৈরী ঘরগুলি নষ্ট করলেন না। রাজমিস্ত্রীকে দিয়ে আরো কিছু কাজ করিয়ে তিনটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট বানালেন। একটা শোবার ঘর। একটা বসার ঘর। ডাইনিং টেবিল বসানোর জন্যে সামান্য কিছু ফাঁকা জায়গা। এই ফ্ল্যাটগুলি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে–খুব সস্তা। ন লক্ষ টাকা। এক সঙ্গে ক্যাশ পেমেন্ট করলে আরো কম–আট লাখ পঞ্চাশ হাজার।
মিনি ফ্ল্যাটও বিক্রি হল না। শেষ পর্যন্ত ভাড়াটে খাজা হতে লাগলো। জামানের মতো কয়েকজনকে পাওয়া গেল। এদের মধ্যে জামান সবচে ভাগ্যবান, কারণ তাকে স্বচে কম ভাড়া দিতে হয়–মাত্র ১৭ শ টাকা। তার ভাড়া কম হওয়ার কারণ হলো, সে ফ্ল্যাটওয়ালাদের এসোসিয়েশনের কিছু কাজকর্ম করে দেয়। সে তাদের একজন পার্ট-টাইম এমপ্লোয়ি।
জামানের এই ফ্ল্যাট খুব পছন্দ! প্রথম দিনেই মুগ্ন গলায় বলেছিল, ফ্ল্যাট যেমন তেমন, কতবড় ছাদ দেখেছ? ছাদের মালিক তো আমরাই। ছাদটা সব সময় থাকবে আমাদের দখলে। বাবু ছোটাছুটি করে খেলতে পারবে। নায়লা, তোমার পছন্দ হয়েছে?
নায়লা হাসলো। তার হাসি দেখে মনে হতে পারে মিনি ফ্ল্যাট তার খুব পছন্দ হয়েছে। আসলে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। এত উঁচুতে মানুষ থাকে? পায়ের নিচে মাটি নেই–এ কেমন থাকা? তাছাড়া ছাদের রেলিং নিচু। বাবু আরেকটু বড় হলেই রেলিং-এ চড়ার চেষ্টা করবে। তখন?
বুঝলে নায়লা, ১৭ শ টাকায় এরকম বাড়ি ঢাকা শহরে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমি হলাম একজন মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। কি রকম হওয়া দেখেছ? ভাদ্র মাসেও দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে। এমনই হবে হাওয়ার যন্ত্রণা। মশারিও খাটাতে হবে না।
মশারি খাটাতে হবে না কেন?
মশা পাখায় ভর করে এত উঁচুতে উঠতে পারে না। যত উপরে উঠবে হাওয়া তত
হালকা হবে। এটা হল সায়েন্সের কথা।
নায়লা বলল, তোমার বাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে?
অবশ্যই হয়েছে। পছন্দ না হওয়ার কোন কারণ আছে? ছাদের উপর জুটা চেয়ার ফেলে রাখব। দুজনে বসে চা খাব। জোছনা রাতে ছাদে বসে চা খাবার মজাই আলাদা। শুধু সিঁড়ি ভেঙে এতদূর উঠা একটা কষ্টের ব্যাপার হবে। তবে বার বার উঠা-নামার দরকার কি?
সিড়ি ভেঙে উঠতে হবে কেন? লিফট আছে না?
লিফট তো আর ছাদ পর্যন্ত আসবে না।
আটতলা পর্যন্ত তে আসবে। সেখান থেকে একতলা হেঁটে উঠবে।
জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, লিফটে উঠা যাবে না নায়লা।
কেন?
ওরা নিষেধ করে দিয়েছে। এসোসিয়েশন। কারণ আমরা ছাদে যারা আছি তারা তো আর লিফটের খরচা দিচ্ছি না। আমরা হচ্ছি ফ্ল্যাটের থার্ড গ্রেড সিটিজন। ড্রাইভার শ্ৰেণী। আমাদের উঠতে হবে হেঁটে হেঁটে।
এটা কেমন কথা?।
জামান উজ্জ্বল মুখে বলল, এর একটা ভালো দিকও আছে। আত্মীয়স্বজন সহজে কেউ আসবে না। মেহমানদারির খরচ বেঁচে গেল। এই জমানায় মেহমানদারির খরচ তে! সহজ খরচ না। বেজায় খরচ।
তুমি সিড়ি ভাঙবে কি ভাবে? অল্প খানিকটা উঠতেই তোমার যে অবস্থা হয়। নিঃশ্বাস নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
আমার কোনই অসুবিধা হবে না। আস্তে আস্তে উঠব। তাছাড়া এক্সারসাইজ হবে। এক্সারসাইজের তো দরকার আছে। এমনিতে তে এক্সারসাইজ হয়ই না। সিড়ি ভাঙার কারণে যদি হয়। শাপে বর হলো আর কি? হা হা হা।
শাপে বর ঠিক হয় নি।
আজ একদিনে চারবার জামানকে উঠা-নামা করতে হয়েছে। বাইরের একজন মেহমান খাবে। বাজার আছে। সব কিছু একসঙ্গে হয় না। প্রথমবার পান আনতে ভুলে গেলো।
পান আনার পর মনে হল, মিষ্টি কিছু থাকা দরকার। জামান আবার রওনা হলো। নায়লা বলে দিল, শোন, লিফটে করে আসবে। হঠাৎ হঠাৎ উঠা। কেউ দেখবেও না।
জামান হাসল, তার মানে সে লিফটে উঠবে না। হেঁটেই উঠবে। কোন মানে হয়?
শোন, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে রওনা দেবে না। অবশ্যই লিফটে আসবে।
আচ্ছা, সেটা দেখা যাবে।
দেখা যাবে টেখা যাবে না। অবশ্যই লিফটে উঠবে।
জামান আবার হাসল।
সব সময় এরকম হাসি দেখতে ভাল লাগে না। রাগ লাগে। নায়লার রাগ লাগছে।
আলম ফুলের তোড়া কিনেছে। পঞ্চাশটা গোলাপের বিশাল-তোড়া। আড়াই শ টাকা নিল তোড়ার দাম। এত টাকা দিয়ে ফুল কেনার কোন মানে হয়? জামান বলল, ফুল কেনাকেনির দরকার কি?
আলম বলল, কোন দরকার নেই। ফুল দিয়ে কি হয়? কিছুই হয় না। লাউ ফুল হলেও একটা কথা ছিল। বড়া বানিয়ে তুই খেয়ে ফেলতিস।
জামান বলল, ঘরে ফুলদানি-টুলদানি নেই। এত ফুল রাখবে কোথায়?