আমি কি ভাবছি সেটা জানার তোর কি দরকার?
দরকার আছে। তাদের এই ব্যক্তিগত ঝামেলায় তুই আমাকে এনে ফেলেছিস। আমার এখানে জড়িয়ে পড়ার কথা ছিল না। আমি জড়িয়ে গেছি। মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা থাকে তারা চালবাজ ধরনের হয়। দেশে এসে বড় বড় চাল দিতে চেষ্টা করে। এই লোক তেমন না।
কি করে বুঝলি?
আমি খুব প্রাকটিক্যাল মেয়ে নায়লা। আমি ভাববাচ্যে চলি না, অনুমানের উপরও চলি না। আমি খোঁজ-খবর করি। নিউ জার্সিতে আমার যে চাচা আছেন আমি তাকে টেলিফোন করে বলেছিলাম ভদ্রলোক সম্পর্কে খোঁজ নিতে। খুব ভাল করে খোঁজ নিতে। উনি খোঁজ নিয়ে জানিয়েছেন।
কি জানা গেল?
জানা গেল যে, ভদ্রলোক শুরুতে আমেরিকা এসে পেট্রোল পাম্পে পেট্রোল ঢালার কাজ করতেন। তারপর ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁকে শুরু করতে হয় একেবারে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট থেকে। তিনি অসাধারণ ভাল রেজাল্ট করেন। পাশ করার পর চাকরি নেন ইউনিয়ন কার্বাইডে। ইউনিভার্সিটিতে কাজের উপর তার তিনটি পেটেন্ট ছিল। সেই তিনটি পেটেন্ট বিক্রি করে এক মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পেয়ে যান। বুঝতে পারছিস কিছু?
বোঝার চেষ্টা করছি।
অগা-মগা-বগা জাতীয় কেউ হলে তার প্রেমে পড়া দোষণীয় হত। এই লোকের প্রেমে পড়ে তুই কোন অন্যায় করিসনি।
নায়লা উঠে দাঁড়াল। এই জাতীয় কথা শোনার তার আর ধৈর্য নেই। অরুন সহজ গলায় বলল, চলে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ
এতক্ষণ যা বলেছি সব নকল কথা। আসল কথা বলিনি।
কোন কথাই শুনতে চাচ্ছি না।
ভাল। শুনতে না চাইলে শুনবি না–তবে আমার কিছু কথা আছে, তা তোর নিজের স্বার্থেই শোনা উচিত।
তোকে আমার স্বার্থ দেখতে হবে না।
আলম সাহেব হোটেলে থাকেন না। হোটেল ছেড়ে দিয়ে এ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেছেন। সেই ঠিকানা আমি ছাড়া কেউ জানে না। তুই আমার সাহায্য ছাড়া তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি না।
তার সঙ্গে যোগাযোগের আমার দরকার কি?
দরকার না থাকলে খুবই ভাল। তোর জন্যেও ভাল, আমার জন্যেও ভাল। আমি তখন নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে করে হানিমুন করবার জন্যে সুইজারল্যান্ড যেতে পারি।
নায়লা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুই আমার সঙ্গে এরকম করছিস কেন? অরুনা বলল, নায়লা বোস। সহজ হয়ে বোস। তোর মনের ভিতর কি আছে বল। একজন কাউকে তো মনের কথা বলতে হবে। বলতে না পারলে তুই তো মরে যাবি! তুই কি আজকাল আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? তোকে দেখাচ্ছে পেত্নীর মত। করাত ধরে তোর ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত বল তো?
নায়লা বসল। তার কান্না পাচ্ছে। অদ্ভুত ধরনের কান্না। সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে। গলায় কান্না জমাট বেঁধে আটকে আছে। কিন্তু চোখ শুকনো!
লায়লা।
হুঁ।
হাত না দেখে আমি বলে দেই তোর কি হবে। ভয়ংকর কিছু তোর জীবনে ঘটতে যাচ্ছে। তোর ছিল সুখী সংসার। হঠাৎ একদিন তুই টের পেলি এটা আসলে সুখী সংসার না। মেকি সংসার। স্বামীকে সহ্য হচ্ছে না–আবার ফেলতেও পারছিস না। ভালবাসার কথা কাউকে বলতে পারছিস না, আবার গোপন রাখতে পারছিস না। বার বার মানুষটার কাছে ছুটে যাচ্ছিস। আবার ঘরে ফিরে চিৎকার করে নিজেকে জিজ্ঞেস করছিস–আমি কি করছি? আমি কি করছি? তোর স্নায়ু চুড়ান্ত রকমের উত্তেজিত। তোর ঘুম হচ্ছে না। তুই অস্বাভাবিক আচরণ করছিস–কিন্তু আচরণগুলি যে অস্বাভাবিক ত্যও ধরতে পারছিস না। এক সময় অস্বাভাবিকতা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। তুই সেই লোকের কাছে যাবি এবং বিশ্রী কিছু কাণ্ড করবি। বাসায় এসে তোর স্বামীর কাছে, তোর ছেলের কাছে যখন পাঁড়াবি তখন মনে হবে–আমি কি করেছি। আমি কি করেছি! বুঝলি নায়লা, এই পর্যায়ে মানুষ পাগল হয়, এই পর্যায়ে মানুষ ছাদ থেকে লাফিয়ে পাড়, ছুটে গিয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে দাঁড়ায়। তোর কি এই অবস্থা যাচ্ছে না?
নায়লা কিচ্ছু বলল না। শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে ধরল।
অরুনা বেয়াবাকে ডেকে দুকাপ চা দিতে বলল। নায়লার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যে ভাবে কাদছিস–লোকজন সব দেখছে।
দেখুক।
অরুনা হাসল। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে।
নায়লা।
উঁ।
তুই তো কখনো বোকা ছিলি না। এরকম বোকার মত কাজ কি করে করলি?
আমি বোকার মত কিছুই করিনি।
যে ধাক্কা আসবে সেটা সামলাতে পারবি?
কি ধাক্কা আসবে?
তুই আলম সাহেবের কাছে গিয়ে বলতে পারবি–আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব। আমার বাকি জীবন আমি আপনার সঙ্গে কাটাতে চাই। এই কথাটা বলার বা এই জাতীয় পরিকল্পনা নেয়ার সাহস কি তোর আছে? না-কি তোর সব সাহস গোপনে ঐ লোকের সঙ্গে রাত্রি যাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
তুই যা ভাবছিস এরকম কিছু হয়নি।
হয়নি, কিন্তু হাবে। খুব শিগগীরই হবে। হয়ত আজই হবে–আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তুই ভদ্রলোকের কাছে ছুটে যাবি এবং …
প্লীজ চুপ।
আচ্ছা যা, চুপ করলাম। চা খা চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
নায়লা ছোট্ট করে কাপে চুমুক দিল। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার জায়গায় তুই থাকলে তুই কি করতি?
আমি যা করতাম সেটা তুই করতে পারবি না। একেক মানুষ একেক রকম। তোর সিদ্ধান্ত তোকেই নিতে হবে।
নায়লা অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি।
অরুনা বলল, পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কষ্ট যেমন চিরস্থায়ী নয় আবার সুখও চিরস্থায়ী না। আলম সাহেবকে না পাবার কষ্ট যত তীব্রই হোক সেটা চিরস্থায়ী না। আবার তোর স্বামী-সন্তানকে হারাবার কষ্টও যত তীব্ৰই হোক—চিরস্থায়ী না। তোর জন্যে সব পথ খোলা। চল্ উঠা যাক।