অরুনার অফিসে এক সকালে নায়লা গিয়ে উপস্থিত। প্লন-প্রোগ্রাম করে যে যাওয়া ত্যা না। রিকশা করে মতিঝিলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল–হঠাৎ মনে হল, আরে এইখানেই তো অরুনার অফিস। নায়লা রিকশাওয়ালাকে বলল, ভাই থামুন তো। থামুন।
অরুনা খুশি-খুশি গলায় বলল, আরে তুই! ব্যাপার কি?
তোকে দেখতে এলাম। তুই ব্যস্ত না কি?
অসম্ভব ব্যস্ত। দেখছিস না তিনটা টেলিফোন সাজিয়ে বসে আছি। তুই কি কোন কাজে এসেছিস, না এম্নি এসেছিস?
এম্নি এসেছি।
তাহলে এই চেয়ারে চুপ করে বসে থাক। দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের লাঞ্চ ব্রেক হবে–তখন তোকে নিয়ে লাঞ্চ করব। দশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকতে পারবি?
পারব মনে হয়।
নায়লা চুপচাপ বসে রইল। অরুনা আসলেই ব্যস্ত। এই টেলিফোন বাজাছ। লোক আসছে। তাকে ডেস্ক ছেড়ে দোতলায় যেতে হচ্ছে, আবার নামতে হচ্ছে। দশ মিনিটের জায়গায় পুরোপুরি চল্লিশ মিনিট পার করে শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অরুনা বলল, চল যাই।
কোথায় যাব? কোন একটা চাইনীজে ঢুকে দুপুরের খাওয়া খাই–তারপর চুটিয়ে আড্ডা। আমাকে আর অফিসে যেতে হচ্ছে না। ছুটি নিয়েছি আড্ডা দেবার জন্যে। অনেক সিরিয়াস ধরনের কথা আছে তোর সঙ্গে। আজ তোর সঙ্গে দেখা না হলে বিকেলে তোর বাসায় যেতাম।
কেন মিথ্যা কথা বলছিস?
অরুনা হাসল। তার কাধের ঝুলানো ব্যাগ খুলে এপয়েন্টমেন্ট বুক বের করে দেখাল যে, আজকের তারিখে লেখা আছে–নায়লার বাসা।
বিশ্বাস হল?
হুঁ।
অরুনা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজকাল কেউ মুখের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। সবাই চায় ভকুমেন্টস। কিছুদিন পর দেখবি মানুষ কথা বলা ভুলে গেছে, সবাই শুধু লেখা চালাচালি করছে। ফ্যাক্স পাঠাচ্ছে, নোট পাঠাচ্ছে।
তারা বসেছে একটা মিনি চাইনীজ। মিনি চাইনীজ মানে সেখানে একজন-দুজনের খাবার অর্ডার দেয়া যায়। চাইনীজের সঙ্গে ফাস্ট ফুড আছে। কেউ দুটা সিঙ্গারা, এক কাপ চা খেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও আছে। অরুনা বলল, নায়লা, তুই কি খাবি বল?
তুই যা খাবি আমিও তাই খাব।
আমি খাব একবাটি স্যুপ। দুপুরে আমি এর বেশি কিছু খাই না। যদি মোটা হয়ে যাই! এম্নিতেই বিয়ে হচ্ছে না, মোটা হলে কি আর উপায় আছে? একবার বিয়েটা শুধু হোক, তারপর দেখবি দিনরাত খাব। খেতে খেতে গ্যাস বেলুনের মত ফুলব।
তখন অসুবিধা হবে না?
না। বিয়ের আগে ছেলেরা চায় দুবলা-পাতলা মেয়ে। বিয়ের পর চায় স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী। বল তুই কি খাবি?
আমি স্যুপ খাব।
না, স্যুপ-টুপ না আয় আজ আমরা ফুল কোর্স লাঞ্চ করি। তোর সঙ্গে অনেক কখা আছে। ধীরে ধীরে খাব আর কথা বলব।
কি কথা?
বলছি, দাঁড়া। আগে অর্ডার দিয়ে নেই।
খাবারের অর্ডার দিয়ে অরুনা একটু ঝুঁকে এল নায়লার দিকে। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বলল, তোর স্বামীর বন্ধু ঐ যে আলম সাহেব, উনার খবরটা কি বল তো?
কি খবর?
মানুষটার ভাবভঙ্গি কিছু বুঝতে পারছি না। ঐদিন তোর বাসায় দেখা হল। তার হাবভাব দেখে মনে হল আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। যাবার সময় আমার টেলিফোন নাম্বার নিলেন। বাসার মেইলিং এড্রেস লিখে রাখলেন। তারপর আর খোঁজ নেই। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে আমি টেলিফোন করলাম। টেলিফোন করে ধাক্কা খেলাম।
কেন?
উনি আমাকে চিনতে পারছেন না। বললেন, কোন অরুনা, শেষে বললাম, নায়লার বান্ধবী।
তখন চিনতে পারলেন?
হ্যাঁ তখন চিনলেন। অনেকক্ষণ গল্পও করলেন।
কি নিয়ে গল্প?
কি নিয়ে গল্প সেটা বলার জন্যেই তোকে এখানে নিয়ে এসেছি। সব গল্প তোকে নিয়ে।
নায়লার হাত-পা শিরশির করতে লাগল। অরুনা ছোট্ট করে হাসল। হাসিমুখে কলল, নায়লা শোন–আমি তো ঘরবন্দি কোন মেয়ে না। পুরুষের সমান তালে বাস করে এমন একটি মেয়ে। রিসিপসনিস্টের কাজ করি। প্রতিদিন কম করে হলেও একশ পুরুষের সঙ্গে মিশতে হয়। বেদে যেমন সাপের হাঁচি চেনে, আমিও তেমন পুরুষের হাচি চিনি। ঐ লোকের সঙ্গে তোর সম্পর্ক কোন পর্যায়ে?
তার মানে?
তার মানে হচ্ছে তোরা এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিস? কথাবার্তা, হাত ধরাধরি এই স্তরে রেখেছিস, না শরীরের স্তরে নেমে গেছিস?
নায়লা চোখ মুখ লাল করে বলল, তুই অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা বলছিস।
আমি কোনই আপত্তিজনক কথা বলছি না। সরাসরি কথা বলছি। পর্দার আড়ালে কথা চালচিালি আমার পছন্দ না। তুই যাসনি ভদ্রলোকের হোটেলে?
হ্যাঁ গিয়েছি।
একজন সুপুরুষ মানুষ দামী একটা হোটেলে একা একা ঘর ভাড়া করে আছে–সুন্দরী এক তরুণী অসময়ে সেই ঘরে উপস্থিত হল। মানুষটা হোটেলের দরজা টেনে বন্ধ করে দিল–তখন কি হয় বল তো?
আমি জানি না কি হয়।
আমি খুব ভাল করে জানি কি হয়! দরজা বন্ধ করা মাত্রই দুটি মানুষ সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা হয়ে যায় পৃথিবীর একমাত্র মানব-মানবী। আর কেউ নেই। আর কারোর অস্তিত্ব নেই। শরীর তখন মনের কথা মানে না। শরীর তখন তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, তুই নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করবি?
হ্যাঁ করব। কারণ আমি আলাদা কেউ না। আমি অন্য সবারই অংশ।
নায়লা কিছু খাচ্ছে না। হাত গুটিয়ে বসে আছে। অরুনা কাঁটা চামচে নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে–আরেকজন যে বসে আছে চুপচাপ সে দিকে তার দৃষ্টি নেই।
নায়লা!
বল।
তুই কি সাহসী মেয়ে?
সাহসী মেয়ে হলে আমাকে কি করতে হবে?
সাহসী মেয়ে হলে বাস্তবকে স্বীকার করতে হবে। নিজে চোখ বন্ধ করে থাকবি এবং ভাববি, সমস্ত পৃথিবী চোখ বন্ধ করে আছে তা তো হয় না। ঐ লোক তোর সম্পর্কে কি ভাবছে না ভাবছে সেটা বাদ দে। তুই নিজে কি ভাবছিস?