কে নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে? তোর বাবা নিবে না। নুরুর তো কোন খোঁজ নেই। ফেরে রাত বারটা একটায়। আমি কি একা ডাক্তারের কাছে যাব?
দরকার হলে যাবে।
জাহানারা আহত গলায় বললেন, আমি ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি–তোর বাবা খুশি। আমি সারাজীবন তার সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করেছি এটা নাকি তার শাস্তি। আমি ককে খারাপ ব্যবহার করলাম এটাইতো জানি না।
নায়লা বিরক্ত গলায় বলল, বুড়ো হলে মানুষের মতিভ্রম হয়। বাবার হয়েছে। তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব মা। তুমি চিন্তা করো না।
জামান কখন আসবে?
ও আসবে না। আমি একা একা কয়েকদিন থাকব।
কেন?
মাঝে মাঝে পুরানো দিনের মত থাকতে ইচ্ছা করে না? আমার ইচ্ছা ছিল বাবুকেও তার বাবার ঘাড়ে ফেলে একা এসে তোমাদের সঙ্গে থাকব।
জাহানারা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শংকিত গলায় বললেন, তোদের কি কোন সমস্যা হয়েছে। সত্যি কথা বল। আমার দিকে তাকিয়ে বল।
কোন সমস্যা হয় নি।
তুই সত্যি কথা বলছিস না।
আমি সত্যি কথাই বলছি। আমাদের কোন সমস্য নেই শুধু …
শুধু কি?
ওকে আমার এখন আর সহ্য হচ্ছে না।
এর মানে কি?
জানি না ওর মানে কি। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলে এটা বোধহয় একঘেয়ে লাগে।
তুই পাগলের মত কথা বলছিস কেন? একঘেয়ে লাগার কি আছে? আমি আর তোর বাবা যে এতদিন একসঙ্গে আছি আমাদের কি ঘেয়ে লাগছে।
অবশ্যই লাগছে। লাগছে বলেই তোমার বাত ব্যথা হলে বাবা এখুশি হয়।
তোর বাবার মাখাটা একটু খারাপ এই জন্যেই সে এরকম বলে–এটা তার মনের কথা না।
বাবার যেমন মাথা খারাপ, আমারো তেমন মাথা খারাপ। আমিতো বাবারই মেয়ে। এইসব নিয়ে তুমি চিন্তা করবে নাতো মা।
আমি চিন্তা করবনাতো কে চিন্তা করবে?
তুমি তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। আমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করব। মা আমি কোন ঘরে থাকব।
জাহানারা চিন্তিত গলায় বললেন, তুই কি অনেক দিনের জন্যে এসেছিস?
জানি না। আমার জিনিসপত্র কোন ঘরে তুলক সেটা বল। আমি অমাির আগের ঘরটায় থাকব না।
ঐ খানে তো নুরু থাকে।
এখন থাকবে না?
ও খুব হৈচৈ করবে।
ও হৈ চৈ করলে আমিও হৈ চৈ করব। মেয়ে হয়েছি বলে আমি হৈ চৈ কম জানি তোমাকে কে বলল?
জাহানারার দাঁত ব্যথা পুরোপুরি সেরেই গিয়েছিল। মেয়ের কান্ড কারখানায় জন্যেই হয়ত সেই ব্যথা আবারো শুরু হল। অসহ্য ব্যথা। তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন।
নায়লা।
কি মা?
জামানতো অসম্ভব ভাল একটা ছেলে–ওর সঙ্গে কি নিয়ে তুই লাগলি?
এক কথা কতবার বলব?
খুব চিন্তা লাগছেরে মা।
চিন্তার কিছু নেই। জামানের সঙ্গে আমার কোন ঝামেলা হয় নি। ও দেশের বাড়িতে গেছে। কদেকদিন থাকবে। তারপর চলে আসবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
জাহানারার দাঁতের ব্যথা আবারো কিছুটা কমল।
নুরু বাসায় ফিরে তার নির্বাসিত অবস্থায় রাগ করল না, বরং বোন কে দেখে আনন্দিত হল বলেই মনে হল। নায়লা বলল, আমার শাড়ি কোথায়? টাকা নিয়ে যে গেলি শাড়ি কোথায়?
আর বল কেন আপা। হারামজাদাতে আমার টাকা মেরে দিয়েছে। আমি জান। দিয়ে তার শাড়ি বেচলাম। তোর শাড়িটার জন্যে টাকা দিলাম। বলল, দুপুরে এসে নিয়ে যেতে তখনই সন্দেহ করা উচিত ছিল যে সামথিং ইজ রং। কিছু বুঝতে পারি নি। মর্থন বুঝতে পেরেছি তখন ইট ইজ টু লেট।
আমার এক হাজার টাকা গেল?
পাগল হয়েছে। তোমার টাকা বাবে যানে–টাকা না দিয়ে ব্যাটা যাবে কোথায়? আমি শুওরের বাচ্চার কানে ধরে সারা শহর চক্কর দেওয়াবো না? আমার টাকা হজম করবে এমন মানুষ এখনো পয়দা হয় নি।
নায়লা গম্ভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় তুই মিথ্যা কথা বলছিস। সবার সঙ্গে ফটকাবাজি করে করে তোর এমন অভ্যাস হয়েছে–বাবা মা, ভাই বোন সবার সঙ্গেই ফটকাবাজী শুরু করেছিস।
আমার সম্পর্কে তোর এই ধারণা অত্যন্ত নির্ম।
কঠিণ কঠিণ বাংলা আমাকে বলার দরকার নেই। তোর দুলাভাই নিতান্তই গরীব মানুষ। তার খুব কষ্টের টাকা।
বললামতো তোর টাকা তুই পেয়ে যাবি। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। শুধু যে টাকা পাবি তাই না। শাড়িও পাবি। শাড়িটা ফাউ!
নায়লা কঠিণ চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নুরু শীষ দিতে দিতে বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় বাবু খেলছে। বাবাকে ছেড়ে এ বাড়িতে এসে শুরুতে তার মনটা খারাপ ছিল। এখন মন খারাপ ভাব নেই। ছোট মামার সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়েছে। ছোটমামা একটা ইঁদুর মেরে ইঁদুরের লেজে সুতা বেঁধে তার হাতে দিয়ে দিয়েছে। বাবু সেই সুতা বাধা ইঁদুর নিয়ে মহানন্দে ঘুরছে।
বাবু ছোটমামাকে দেখে আনন্দিত গলায় বলল, মামা ইন্দুল।
নুরু উদাস গলায় বলল, হ্যাঁ বাবা ইল। ইঙ্গুল দিয়ে আপাতত খেল। দেখি যদি পারা যায় একটা বিড়াল মেরে গলায় দড়ি বেঁধে হাতে দিয়ে দেব। এতে আরো মজা পাবে।
বাবু হাসল। মামার কথাতেই সে মজা পাচ্ছে।
নায়লার অস্থির ভাবটা কেটে গেছে। মার বাড়িতে থাকতে তার ভালই লাগছে।
একজন বিবাহিত মেয়ে কোনদিনই কুমারী জীবনে ফিরে যেতে পারে না, কিন্তু কাছাকাছি হয়ত যাওয়া যায়। চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়। নায়লা সেই চেষ্টা প্রাণপন করছে। দিনের বেলা সে সেজেগুজে ঘুরতে বের হয়।
এই সময় তার খুব ব্যস্ত ভঙ্গি থাকে। যেন জরুরি কোন কাজে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।
একদিন সাভার স্মৃতিসৌধ (থকে একা একা ঘুরে এল। একগাদা মাটির খেলনা নিয়ে এল। চীন মৈত্রী সেতুও দেখা হল। সুন্দর বানিয়েছে। জোছনা রাতে এই সেতুর উপর হাঁটাহাটি করতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। ছেলে হয়ে জন্মালে এই কাজটা করা যেত। আচ্ছা, চুল ছোট করে কেটে শার্ট-প্যান্ট পরে ছেলে সাজলে কেমন হয়? তাহলে নিশ্চিন্ত মনে ঘোরাঘুরি করা যায়। মেয়েরা এতদিন ধরে পুরুষের পাশাপাশি রাস্তায় হাঁটছে। তারপরেও পুরুষরা অভ্যস্ত হচ্ছে না কেন? এখনো কেন মেয়ে দেখামাত্র আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে?