এটা কিন্তু ভুল। খুব ভুল।
না ভূল না। তা ছাড়া নায়লা ভূলানোর কায়দা কানুনও আমি জানি না।
মেয়েদের বিশেষ করে স্ত্রীদের ভুলানো অসম্ভব সহজ। মন্ত্রীরা যে সব জিনিস পছন্দ করে–মাঝে মধ্যে সেই সব করবে।
জামান হালকা গলায় বলল, তুমি বেড়াতে পছন্দ কর। টাকা পয়সা খরচ করতে পছন্দ কর। আমি সেই সব পছন্দ মেটাব কি করে বল।
থাক তোমাকে মেটাতে হবে না। মাঝে মাঝে আমাকে তুমি গয়নার দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনবে। না-কি সেটাও পারবে না?
পারব।
শুধু শুধু চা খাচ্ছ যে তোমার সিগারেট নেই?
না।
আমার কাছে চাচ্ছ না কেন?
আছে তোমার কাছে?
অবশ্যই আছে। আজ নিউ মার্কেটে গিয়ে প্রথম যে জিনিসটা কিনেছি সেটা হচ্ছে এক প্যাকেট সিগারেট। রাস্তায় দাড়িয়ে যে সিগারেট বিক্রি করে ওদের বললাম, সবচে দামী সিগারেট এক প্যাকেট দিন তো। সেই এই সিগারেট দিল। খেয়ে দেখতে কেমন?
দাম কত?
দাম শুনলে তো তুমি আর খেতে পারবে না। কাশতে থাকবে। একশ কুড়ি টাকা দাম।
সর্বনাশ। তোমার সাহসের তো নায়লা সীমা পরিসীমা নেই–একশ কুড়ি টাকা দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে? একটা শলার দাল ছ টাকা।
এত দাম হিসাব করতে হবে না। খাও তো। আর শোন আমিও কিন্তু একটা টান দেব। তুমি হাসতে পারবে না। দামী সিগারেটে একটা টান দিয়ে দেখি কেমন লাগে।
সত্যি টান দেবে?
হুঁ।
নায়লা সিগারেটে টান দিয়ে খুকখুক করে কাশতে লাগল। তার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল–সর্বনাশ।
জামান হাসছে।
নায়লা বলল, শখ করে কেউ এই জিনিস খায়?
জামান বলল, ঠাণ্ডা লাগছে চল ভেতরে যাই।
নায়লা বলল, আর একটু বস পাঁচ মিনিট।
দুজন চুপচাপ বসে আছে। জামান তাকিয়ে আছে নায়লার দিকে। নক্ষত্রের আলোয় কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
জামান বলল, তোমার মনে কি অনেক কষ্ট নায়লা?
নায়লা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ।
কেন বলতো?
কি হবে বলে।
একেকজন মানুষের একেক রকম কষ্ট। তোমার কষ্টটা কি রকম শুনে দেখি।
নায়লা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–ছোটবেলা থেকে আমার খুব গানের শখ ছিল। আমি অন্যের কাছে শুনে শুনে গান তুলতাম। সবাই বলতে এত ভাল গলা। এত ভাল গলা। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখন আমাদের স্কুলের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে খুব বড় একটা ফাংশান হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী এসেছিলেন। সেখানে আমি একটা গান গয়েছিলাম। উনি আমাকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন — এই মেয়ে গান গেয়ে একদিন ভুবন বিখ্যাত হবে। আজ তো তুমি দেখছই ভুবন বিখ্যাতের নমুনা। চল ঘুমুতে যাই। আসলেই ঠাণ্ডা লাগছে।
তোমার বাবা গান শেখার কোন ব্যবস্থা করে দেন নি?
কোত্থেকে দেবেন? ভাত খাবার পয়সা নেই। আমাদের স্কুলের গানের অপা আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। বাবা সেই হরিমোনিয়াম রাখেন নি ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
কেন?
জানি না কেন? আমি শুধু কেঁদেছি–বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। মানুষের সব দুঃখ একসময় কমে যায়। আমার গান শিখতে না পারার দুঃখ কোনদিন কমবে না। যখন কোন সুন্দর গান শুনি তখনই মনে হয়–আমিতো এরচে সুন্দর গাইতে পারতাম। চল ঘুমুতে যাই। ও আচ্ছা তোমাকে কিন্তু আরেকটা কথা বলা হয়নি। আমি তোমার বন্ধুকে একটা পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছি। উনি এত উপহার দিয়েছিল আমার লজ্জা লাগছিল।
পাঞ্জাবী দিয়েছ ভাল করেছ।
নায়লা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
দুটা স্যুটকেস, একটা বড় ঝুড়ি
দুটা স্যুটকেস, একটা বড় ঝুড়ি ভর্তি বাবুর জিনিসপত্র নিয়ে নায়লা তার মার বাসায় উপস্থিত হল। ফিরুর মা সঙ্গে এসেছে। বাবু তার কোলে বসে আছে। জামান আসেনি। সে ১০ টার ট্রেনে দেশের বাড়িতে চলে যাবে।
মোর্তজা সাহেব মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কি কে?
নায়লা বলল, কোন ব্যাপার না। তোমাদের দেখতে এলাম। তোমরা কেমন আছ বাবা?
আমি ভালই আছি। শুধু তোর মার অবস্থা কাহিল। দাঁত ব্যথা।
দাঁত ব্যথাতো অনেক আগেই শুনেছি। এখনো সারে নি?
একটা সেরেছে আরেকটা শুরু হয়েছে সারাজীবন আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে এখন শোধ বোধ হচ্ছে। আল্লাহ কাউকে ছাড়েন না। শোধ বোধ করে দেন।
কি যে তুমি কল বাবা।
সত্যি কথা বলি। তোর ব্যাপারটা কি? কথা বালিশ নিয়ে উঠে এসেছিস। জামানের সঙ্গে ঝগড়া।
না ঝগড়া টগড়া না। আমি তোমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকতে এসেছি। নিজের মত করে থাকব।
জামান একা থাকবে?
দু একদিন থাকবে এক।
খাবে কি?
বিয়ের আগেতো একা থাকতো। তখন ভাত খেতো না? একটা ব্যবস্থা করে নেবে।
তোদের ঝগড়া কি নিয়ে?
বললাম তো ঝগড়া না।
মোর্তজা সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন–যা তুই তোর মার সঙ্গে কথা বল। ফিরুর মা, তুমি থাক। তোমার সঙ্গে কথা আছে। এটাকে কোলে নিয়ে ঘুরছ কেন? নামিয়ে দাও। কোলে নিলেই বাচ্চা কাচ্চা নষ্ট হয়। এখন বল–ওদের ঝগড়া কি নিয়ে?
ঝগড়া হয় নাই।
ঝগড়া হয় নি?
জে না। ভাইজান ঝগড়ার মানুষ না।
বিনা ঝগড়ায় জামানকে ফেলে নায়লা চলে এসেছে। এটাতো অবিশ্বাশ্য ব্যাপার। যাই হোক তুমি চা বানাতে পার?
পারি।
যাও আমার জন্য চা বানাও। চিনি কম, দুধ কম।
মোতৰ্জা সাহেব চিন্তিত মুখে তার ইজিচেয়ারে বসলেন।
জাহানারার দাঁত ব্যথা কাল রাত পর্যন্তও প্রচণ্ড ছিল। সারারাত ঘুমুতে পারেন নি। এখন একটু কম। লবন পানি দিয়ে অনেকক্ষণ গার্গল করায় ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। তবে গাল ফুলে বিশ্রী হয়ে আছে।
নায়লা বলল, ডাক্তারের কাছে যাওনি মা?