নায়লা হাসল। প্রাণহীন হাসি জামান বলল, আমি যে কি রকম দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম … তুমি আরেকটু দেরি করলে আমার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেত। নায়লা কিছু বলল না। তার হাতে বাবুর লাল বল। বেবীটেক্সিতে করে সে একটা ফুলের টবও এনেছে। ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কিনেছে। রাবার গাছের চারা।
জামান আবার বলল, তুমি কোথায় ছিলে?
নায়লা বলল, রাস্তায়।
নায়লা লিফটের দিকে এগুচ্ছে। জামান বলল, তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। লিফট আজ সন্ধ্যা থেকে নষ্ট।
নায়লা নিঃশব্দে সিড়ি ভাঙ্গছে। জামানের কাছে খুব অবাক লাগছে যে নায়লা এখনো জিজ্ঞেস করছে না–বাবু কেমন ছিল? কেন সে জানতে চাচ্ছে না? এ রকম করছে কেন শায়লা?
বাসার দরজার কাছে এসে নায়লা থমকে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল–বাবু কান্না কাটি করেছিল?
জামান মিখ্যা করে বলল, অল্প তেমন না।
বাবু ঘুমুচ্ছে। তার গাল ভেজা। নায়লা ছেলেকে দেখল কিন্তু আদর করল না। বাবুর গালে মশা বসেছে, নায়লা মশাটাকেও মারল না।
ফিরুর মা গোসলের পানি দাও তো?
আফনে ছিলেন কই আম্মা। চিন্তায় চিন্তায় ভাইজানের মুখ শুকাইয়া বস্টি হইয়া গেছে।
তোমাকে গোসলের পানি দিতে বলছি পানি দাও। বাবুর উপর মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে যাও।
জামান লক্ষ্য করল নায়লা তার চোখে চোখে তাকাচ্ছে না। এমন ভাব করছে যেন ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। জামনি বলল, কেনাকাটা কি করেছ?
কিছু করি নি।
জামান বলল, তুমি কিছুদিন তোমার বাবা-মার সঙ্গে থাক।
কেন?
এতে তোমার অস্থির ভাবটা দূর হবে।
আমার অস্থির ভাব তোমাকে কে বলল?
কেউ বলেনি–দেখতে পাচ্ছি।
বেশি দেখতে যেও না। বেশি দেখা ভাল না। বেশি দেখতে গেলে আফসোসের সীমা থাকবে না। এক সময় চিৎকার করে বলবে, হায় হায় কেন বেশি দেখতে গেলাম…
তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না।
না বোঝাই ভাল।
তুমি কদিন তোমার বাবা মার সঙ্গে থাকলে আমার সুবিধা হয়। দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারি। অনেক দিন যাওয়া হয় না। যাওয়াও দরকার …।
যাওয়া দরকার হলে যাও। আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই। আমি কোথাও যাব না। এই এখানেই থাকব। তুমি যা ভাবছে তা হবে না।
আমি কি ভাবছি?
নায়লা কঠিণ গলায় বলল, তুমি ভাবছ–তুমি দেশের বাড়িতে চলে যাবে। খালি ফ্ল্যাট পরে থাকবে–রোজ আলম আসবে। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে। কোন কোন বার রাত এত বেশি হবে যে সে হোটেলে ফিরবে না। থেকেই যাবে।
জামান অবাক হয়ে বলল, আমি কখনো এরকম কিছু মনে করিনি। কখনো না।
সাধু সাজতে যেও না। আমার কাছে সাধু সেজে পার পাবে না। আমার দেরি দেখে তুমি যে অস্থির হয়েছ, কি জন্যে অস্থির হয়েছ তুকি মনে করেছ আমি জানি না? খুব ভাল করে জানি। তুমি ভেবেছ আমি তোমার বন্ধুর হোটেলে বসে আছি।
আমি এরকম কিছু ভাবি নি নায়লা।
তোমার বন্ধুর সঙ্গে আমার অবশ্যি দেখা হয়েছে। তাকে একটা জিনিস দিতে গিয়েছিলাম। এত কোথায় ছিলাম তাও বলি–খানিকক্ষণ রাস্তায় ঘুরেছি তারপর অরুনার বাসায় গিয়েছিলাম। এখন তুমি কি আমাকে জেরা করতে চাও? জেরা করতে চাইলে জেরা কর।
জামান তাকিয়ে আছে। ফিরুর মা বাথরুমে পানি দিয়ে এসে খবর দিল। নায়লা শান্তভঙ্গিতে বাথরুমে ঢুকল। সারাগায়ে সাবান মেখে আজ সে অনেকক্ষণ গোসল করবে। গোসল করে সে ছাদে বসে গরম এক কাপ কফি খাবে। ইনস্ট্যান্ট কফির একটা কৌটা সে কিনে এনেছে। কফি খেতে ভাল লাগে না, কিন্তু কফির গন্ধটা সুন্দর!
জামান বাবুর পাশে শুয়েছিল। তার চোখ বন্ধ কিন্তু নায়লা বুঝতে পারছে সে জেগে আছে। নায়লা চুল আঁচড়াল। কাজলদানী থেকে কাজল দিল। কি মনে করে ঠোটে লিপিস্টিক দিল। আয়নায় নিজেকে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকল কফি বানাতে। ফিরুর মা ভাত তরকারী গরম করছে। ফিরুর মা বলল, ভাত খাইবেন না আম্মা?
না। তোমার ভাই খেয়েছে?
না ভাইজানও খায় নাই। ভাইজান সন্ধ্যাকালেই বলছে ভাত খাইব না–তার শইল খারাপ।
তুমি ভাত খেয়ে শুয়ে পর।
আমি ভাত কোন কালেই খাইছি। আমরা হইলাম গরীব মানুষ, ভাত না খাইলে আমরার পুষে না। ধনীর উল্টা নিয়ম ভাতের বদলে চা খাইলেও পুষে।
ফিরুর মা, তুমি যেমন গরীব আমরাও সে রকম গরীব। ধনী কাকে বলে তুমি জান না।
না জানাই ভাল আম্মা।
এটা ঠিক বলেছ না জানাই ভাল। ফিরুর মা ছাদে পাঠি টা পেতে দিয়ে এসে তো।
ও আল্লা এই শীতে ছাদে বইবেন? মাথার উপরে তো আম্মা উস পড়ব।
পড়ুক। আর শোন এই দুটা কাপ ছাদে রেখে এসো।
বড়লোকের কাজ কারবার বোঝা বড় দায় তো আম্মা। বড়লোক হইল আম্মা আল্লাপাকের এক আজব জীব।
হয়েছে কথা বন্ধু।
নায়লা জামানের গায়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, এই আস তো।
জামান উঠে বসল। নায়লা কোমল গলায় বলল, এক টিন কফি কিনেছি। এসে বড়লোকদের মত কফি খাই।
নায়লা হাত ধরে জামানকে নামাল। জামানের বিস্ময়ের সীমা রইল না। নায়লার ব্যাপারটি। সে এরকম করছে কেন? নায়লা বলল, আমার কথাবার্তা শুনে তোমার আক্কেল গুড়ুম হয়েছে তাই না? রাগ করো না। হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। এই দেখ তোমাকে ভুলানোর জন্যে রাত দুপুরে সেজেছি।
আমাকে ভুলানোর কোন দরকার নেই।
দরকার আছে। স্ত্রীর উচিত স্বামীকে ভুলানোর চেষ্টা করা আবার স্বামীর উচিত স্ত্রীকে ভুলানো! তুমি আমাকে ভুলানোর জন্যে কখনোই কিছু কর না। আমি কিন্তু করি।
জামান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমাকে ভুলানোর জন্যে আমি কখনো কিছু করি না–কারণ আমি জানি তোমাকে ভুলানোর কোন দরকার নেই।