গেটের কাছে দারোয়ান ছগির মিয়া বিড়ি টানছিল। বিড়ি লুকিয়ে ফেলে বলল, স্যার, ভাল আছেন? তার গলায় অন্যদিনের চেয়েও বেশি আন্তরিকতা।
জামান বলল, ভাল আছি।
আপনের খবরে মনটা খুব খারাপ হইছে স্যার।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে। ঠিক আছে?
দারোয়ানের সহানুভূতি জামানের ঠিক ভাল লাগছে না। আবার কারো সহানুভূতি তুচ্ছও করা যায় না। জামান অফিসে ঢুকল। তার চেয়ারটা খালি। টেবিলের ফাইলপত্র সরানো হয়নি। জামানের পাশের টেবিলের ইলিয়াস সাহেব উচু গলায় বললেন–আরে জামান ভাই যে, আসেন আসেন।
সবাই তাকাচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।
জামানের মনে হল, অফিসে আসাটা ভুল হয়েছে। না এলেই হত।
আপনার কোন খোঁজখবরই নাই। কি ব্যাপার বলুন দেখি।
এই ত আসলাম। কেমন আছেন?
আর থাকাথাকি! বসেন দেখি, চা খান।
ইলিয়াস সাহেব জামানকে চা খাওয়ার জন্যে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্যস্ততাটাও চোখে পড়ে।
চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাল করেছেন। গুড ডিসিসান। এখন ব্যবসা করুন। ব্যবসা ছাড়া বাঙালীর উন্নতি নেই। চাকরি আরো আগেই ছাড়া উচিত ছিল।
ইলিয়াস সাহেব এমন ভঙ্গি করছেন যেন জামান নিজেই চাকরি ছেড়েছে, তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়নি। এই জাতীয় ছেলেমানুষী কথাবার্তার মানে আছে?
জামান সাহেব!
জ্বি।
দশটা-পাঁচটা অফিস করে বাঙালী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। বাঙালী এখন মেরুদণ্ডবিহীন জাত। চাকরি ছেড়ে আপনি কাজের কাজ করেছেন।
চাকরি তো আমি ছাড়িনি, ওরা ছাড়িয়ে দিয়েছে।
একই ব্যাপার। সিঙ্গারা খান। চায়ের সঙ্গে গরম গরম সিঙ্গারা ভাল লাগবে।
জামান চা খেল। সিঙ্গারা খেল। অকারণে বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠে দাঁড়াল। ইলিয়াস সাহেব বললেন, চলে যাচ্ছেন নাকি?
জ্বি।
আবার আসবেন। মাঝে মধ্যে আপনাকে না দেখলে ভাল লাগে না। নিন, সিগারেট নিয়ে যান।
জামালকে সিগারেট নিতে হল। ফেরার পথে সে ক্যাশিয়ার আবদুল করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। করিম সাহেব জামানকে দেখে নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, বসুন। হাতের কাজ সেরে নেই।
বসব না। আজ যাই।
বসতে বলছি, বসুন।
জামান বসল। করিম সাহেব হাতের কাজ সারতে এক ঘণ্টার মত সময় নিলেন। এক ঘণ্টা পর মুখ তুলে বললেন–আপনার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কাগজপত্র সব রেডি করে ফেলেছি। সব মিলিয়ে আপনি পাচ্ছেন একুশ হাজার দুশ তিপ্পান্ন টাকা। আগামী সোমবার আসবেন। আমি চেক আপনার হাতে দিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
আপনার বেতন হিসাব করে দেখলাম, আপনি কিছু টাকা পান। পে ফিক্সেশনে ভুল ছিল। আপনি অফিসের কাছে তেইশ শ নব্বই টাকা পান। টাকা নিয়ে যান। রেভিন্যু স্ট্যাম্প আছে?
জ্বি না।
রেভিন স্ট্যাম্পের জন্যে দু টাকা দিন। দিয়ে সই করুন। ক্যাশ টাকা নিয়ে যান।
জামান সই করল। টাকা নিল।
টাকা গুনে নিন ভাই।
আবারও কি একশ টাকা বেশি দিয়েছেন?
না, বেশি দেইনি।
তাহলে আর মুনার দরকার নেই।
হঠাৎ এই টাকাটা পেয়ে কি খুশি হয়েছেন জামান সাহেব? ওই টাকা তো পাওয়ার কথা ছিল না। বলুন, খুশি হয়েছেন?
জ্বি।
আপনার চাকরি যে চলে গেছে এটা ভাবীকে বলেছেন?
এখনো বলিনি।
আমিও তাই ভেবেছি। পারেননি। বলা সম্ভবও না। পৃথিবীর সবার কাছে ছোট হওয়া যায়, স্ত্রীর কাছে ছোট হওয়া যায় না। আমার দুবার চাকরি গিয়েছে। এই ব্যাপারটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। জামান সাহেব, আমার একটা উপদেশ শুনুন–এই যে টাকাটা পেলেন, এটা ভাবীর হাতে দিয়ে দিন। ভাবীকে বলুন ইচ্ছেমত খরচ করতে। ভাবী এতে খুব আনন্দিত হবেন। আনন্দ থাকতে কিতে এক সময় আপনার দুঃসময়ের কথা বলুন।
এতে তো কষ্টটা আরো বেশি হবার কথা।
হবে না। সেই বুদ্ধিও শিখিয়ে দিয়ে দেই। ভাবীকে বললেন–এই চাকরির চেয়েও ভাল একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে।
মিথ্যা কথা বলা হবে?
মিথ্যা কথা বলবেন। আপনি তো আল-আমিন না যে সব সময় আপনাকে সত্য কথা বলতে হবে। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। শুধু সিমেন্ট দিয়ে ইট গাঁথা যায় না। সিমেন্টের সঙ্গে বালি মিশাতে হয়। সিমেন্ট যদি সত্যি হয়–মিথ্যা হল বালি। এই দুইয়ের মিলিত ফল হল বিশাল ইটের গাঁথুনি।
যা সত্যি তাই ওকে বলব বলে ঠিক করেছি।
ঠিক আছে ভাই সত্যবাদী–বলুন। চাকরি-বাকরির চেষ্টা কিছু করছেন?
না।
না করে ভালই করেছেন। চেষ্টা করেও কিছু হবে না। দেশে সব কিছু আছে, চাকরি নেই। আমি কি আপনার জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা দেখব? আপনার মত অবস্থা আমার যখন হয়েছে তখন ঐ বিকল্প ব্যবস্থার উপর বেঁচেছিলাম। ঐ লাইন আমি কিছুটা জানি।
বিকল্প ব্যবস্থাটা কি?
টিউশানি। রমরমা ব্যবসা। অনেক পয়সাওয়ালা অপদার্থ বাবা-মা আছে যারা তাদের ছেলেমেয়ের জন্যে দেড় হাজার, দুহাজার টাকা বেতনে প্রাইভেট টিউটর রাখে। এ রকম দুটা জোগাড় করতে পারলে আপনার সমস্যার সাময়িক সমাধান হবে। চেষ্টা করব?
প্রাইভেট টিউশনি কখনো করিনি।
করেন নি, এখন করবেন।
কি পড়াব তাও তো জানি না।
থ্রি-ফোরের বাচ্চা পড়াবেন, তেমন কিছু জানতেও হবে না। বাবা-মারা তো আর পরীক্ষা নিতে আসছেন না আপনি কি পড়াচ্ছেন। আপনি যখন পড়বেন–তারা তখন স্টার টিভি দেখবে কিংবা পার্টি-ফার্টিতে যাবে। কি, চেষ্টা করব?
জামান কিছু বলল না। করিম সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, আমি কি বলছি মন দিয়ে শুনুন। পরশু দিন সন্ধ্যার পর আমার বাসায় আসুন। সারভাইভালের চেষ্টা তো করতে হবে রে ভাই, হবে না?