বাবু ঘুমের মধ্যেই বলল, মাম্মাটের কাছে যাব। আমি মাম্মাটের কাছে যাব।
জামান ছেলের গায়ে হাত রেখে তাকে আদর করছে। বেচারা আজ মার আদর তেমন পায়নি। ঘুমের মধ্যেও সেই না পাওয়ার অস্থিরতা চলে আসছে। জামান বলল, নায়লা, ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
আমার অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে, তোমাকে বলা দরকার।
ঝামেলার কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। অন্য কিছু বলার থাকলে বল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জামান বলল, তুমি খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি। তোমার কি হয়েছে?
আমার কিছু হয়নি। জানালাটা বন্ধ করে দেবে? ঠাণ্ডা বাতাস আসছে।
জামান উঠে জানালা বন্ধ করল। নায়লা বলল, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াও জামান পানি এনে দিল। নায়লা পানি খেল না। এক চুমুক দিয়েই গ্লাস ফিরিয়ে দিল। তার আসলেই কেমন জানি অস্থির লাগছে। জানালা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটাও যেন অনেকখানি গরম হয়ে পড়েছে। নায়লা গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল। এখন তার ইচ্ছা করছে–দরজা খুলে ছাদে গিয়ে বসে থাকতে।
জামান বলল, তোমার কি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
কেন বল তো?
বুঝতে পারছি না। বাতিটা জ্বালাও।
জামান বাতি জ্বালাল। নায়লা বলল, তোমার বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা আমার উচিত হয়নি। খুব ভুল হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা কি হয়েছে তোমাকে বলি…
আমাকে কিছু বলার নেই। তুমি ওর সঙ্গে ছবি তুলে তাতে কি হয়েছে?
অনেক কিছুই হয়েছে। না শুনলে তুমি বুঝবে না। উনি সাভার যাবেন, আমাকেও নিয়ে যাবেন। আমি যেতে চাইনি, উনি এমন জোর করলেন যে আমি না বলতে পারলাম না…
তুমি কেন কেউ পারবে না।
আমি তো আগে কখনো স্মৃতিসৌধে যাইনি–এত ভাল লাগল! ছবি তুলতে ইচ্ছা করল। উনাকে বলতেই উনি ক্যামেরা নিয়ে এলেন। এক সময় তার গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন আমাদের দুজনের ছবি তুলে দিতে। বলেই তিনি আমার পাশে পঁড়ালেন। কখন যে তিনি তাঁর হাত আমার কাধে রেখেছেন বুঝতেই পারিনি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খারাপ লেগেছিল বলে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি …
তোমার খারাপ লাগার কিছু নেই।
তুমি নিজে ভাল মানুষ বলে পৃথিবীটা তোমার মত করে দেখ। পৃথিবীর সব পুরুষই তুমি তোমার মত মনে কর। পৃথিবীর পুরুষগুলি তোমার যত না। পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। তোমার বন্ধু সম্পর্কেও খারাপ। ঐ দিন আমার সঙ্গে ছবি তোলার পর থেকে তার ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল…
কি যে তুমি বল!
আমি ঠিকই বলি। আমি ভুল বলি না। যেহেতু ঐ দিন ছবি তোলার সময় আমি আপত্তি করিনি কাজেই সে প্রশ্রয় পেয়ে গেল। প্রশ্রয় পেল বলেই এই ধরনের অস্বাভাবিক কথা সে বলতে পারল।
জামান মৃদু স্বরে বলল, আলম হল পাগল টাইপের। ও কি মনে করে কি বলেছে কে জানে। ওর কথায় অস্থির হয়ো না।
আমি অস্থির হয়ে আছি তোমাকে কে বলল? অস্থির হবার মত কি ঘটেছে? কিছুই ঘষ্টেনি। ফালতু ধরনের একটা ছেলে যদি আমাকে কিছু বলে বসে তাতে কি যায় আসে। আমি তো ফালতু মেয়ে না।
চট করে কাউকে ফালতু বলা ঠিক না।
যে ফালতু তাকে ফালতুই বলতে হয়। তোমার প্রাণের বন্ধুর স্বভাবটা কেমন তুমি জানতে চাও?
ওর স্বভাব কেমন আমি জানি নায়লা।
না, তুমি জান না। একজন পুরুষ অন্য একজন পুরুষের আসল স্বভাব কখনো ধরতে পারে না। একজন মেয়েই শুধু পারে। আমি বলি তোমার বন্ধুর স্বভাব কেমন। তার হল মেয়ে-ঘেঁসা স্বভাব। মেয়ে দেখামাত্রই তার মনে ছোক ছোক ভাব হয়। সে এমন একটা ভাল করে যেন প্রেমে পড়ে গেছে। মেয়েরা তার এই ভঙ্গিতে প্রতারিত হয়, ধরা দেয়।
তুমি কি প্রতারিত হয়েছ?
নায়লা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমি প্রতারিত হব কেন?
এম্নি বললাম।
না, তুমি এম্নি কলনি। তোমার মনে অন্য কিছু আছে। তুমি কি ভাব আমাকে?
জামান হকচকিয়ে গেল। নায়লা হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে গেল কেন?
তোমার কি ধারণা তোমার বন্ধুর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি?
এইসব কথা কেন আসছে?
কারণ আছে বলেই আসিছে। কারণ না থাকলে আসত না। তোমাকে আমি চিনি–তুমি ভালমানুষের মত ভঙ্গি করে থাক। ভঙ্গি পর্যন্তই। তোমার ভেতরটা অন্য পুরুষদের মতই অন্ধকার। তুমি কি ভেবেছ, তোমার মত ভালমানুষ পুরুষ আগে দেখিনি? দেখেছি। এরকম একজনের সঙ্গে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। তখন ধারণা হয়েছিল এই মানুষটার মত মানুষ পৃথিবীতে আর জন্মায়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই মানুষ আমাকে নিয়ে কি করল জানতে চাও? জানতে চাইলে বলতে পারি। শুনলে তুমি কলার খোসার মত আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে।
নায়লা হাউ মাউ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দে বাবু উঠে পড়েছে। সেও কাঁদতে শুরু করেছে। জামান তাকিয়ে আছে হতভম্ব হয়ে।
জামান অফিসে ঢুকল লজ্জিত ভঙ্গিতে
জামান অফিসে ঢুকল লজ্জিত ভঙ্গিতে। যেন অপরিচিত কারো বাড়িতে সে ঢুকতে যাচ্ছে। এক্ষুণি বাড়ির দারোয়ান বলবে, কাকে চান? কি প্রয়োজন? জামান এই মুহূর্তে কাউকে চাচ্ছে না। তার তেমন কিছু প্রয়োজনও নেই। তিন মাসের বেতন তাকে মাসের এক তারিখেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্যাশিয়ার বজলুর রহমান বলেছেন, প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা আপনাকে পরে হিসাব করে দিয়ে দেব। কয়েকদিন যাক, তারপর আসুন। চার দিন মাত্র গিয়েছে। এই চার দিনে কিছু হবার কথা না। তবু জামান এসেছে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকার জন্যে যে এসেছে তা না। কেন এসেছে নিজেও জানে না। কে জানে, হয়ত লজ্জা পাওয়ার জন্যেই এসেছে।