জামান ওদের আগিয়ে দিতে গেছে। নায়লা ফিরুর মাকে বলল বাতি নিভিয়ে মশারি খাঁটিয়ে দিতে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। সে বাবুকে নিয়ে শুয়ে থাকবে।
খাবার টেবিল নোংরা হয়ে আছে। টেবিল পরিষ্কার করতে হবে। তাকেই করতে হবে। ফিরুর মাকে দিয়ে হবে না। সে কাচের জিনিস ভাঙবে। ইচ্ছা করেই ভাঙবে।
ফিরুর মা বলল–আইট্যা বাসুন কি ধুমু আম্মা?
না। তুমি খেয়ে নাও।
ভাইজানরে কি পেলািও গরম কইরা দিমু? ভাইজানের খাওয়া হয় নাই। খাওনের মাঝখানে উইঠা গেল।
ভাইজানের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি তোমার চিন্তা কর।
জামান ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতে গিয়েছে এগারোটা দশে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। এর মধ্যে ফিরুর মা দুবার নিচে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। কেউ নেই। মানুষটা গেল কোথায়?
নায়লার ভয় ভয় লাগছে। ঢাকা বিচিত্র শহর। কত কি হতে পারে। তার ইচ্ছা করছে নিজেই একবার খোঁজ নিয়ে আসে। যদিও তা সে করল না। ঘর পরিষ্কার করল। খালা-বাসন ধুয়ে শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে মুছল। সন্ধ্যাবেলাতেই সে একবার গোসল করেছে। আবার পানি গরম করে গোসল করল। গোসলের পারে মাথায় ভার ভার ভাবটা দূর হয়েছে। ভাল লাগছে। ফিরুর মা চা বানিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড ক্লান্তির পর গরম চ-টা খেতে ভাল লাগছে।
ভাত খাওয়া হয়েছে ফিরুর মা?
জ্বে না।
খাওনি কেন?
ভাইজান ফিরতাছে না। ডরে আম্মা শইল কাঁপতাছে।
শরীর কাঁপাকাপির কিছু না। তোমার ভাইজান কচি খোকা না। যাও খেতে বোস।
নিচে দারোয়ানরে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজানরে দেখছেন? হে আমার সাথে মশকারা করে। আমারে কয় কি–আমি রাইতকানা, রাইতে চউক্ষে দেখি না।
চুপ কর তো! কথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি।
অল্পে অস্থির হওয়া তো আম্মা ভাল না।
তোমাকে আমি আর রাখব না ফিরুর মা। তুমি দেশে চলে যাবে।
আইচ্ছা।
জামান ফিরেছে। এত দেরি করে যে ফিরেছে তার জন্যে কোন দ্বিধা কোন সংকোচ নেই। আশ্চর্য মানুষ তো! নায়লা দেখছে মানুষটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে হাত-পা ধুচ্ছে। প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে বলল, চল শুয়ে পড়ি।
নায়লা বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
অলিম ধরে নিয়ে গেল। অরুণাকে নামিয়ে ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরলাম।
রাত দুপুরে ঘুরলে?
আলমকে তো তুমি জান না। ও কিছু বললে না করা মুশকিল। ও আচ্ছা, তোমার ছবিগুলি সে দিয়ে দিয়েছে।
আমার কি ছবি?
ওর সঙ্গে সাভার গিয়েছিলে–ছবি তুলেছ, সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি এসেছে। টেবিলের উপর রেখেছি। দেখো।
নায়লা শক্ত হয়ে গেল। জামান কি ব্যাপারটায় কিছু মনে করেছে? ছবি দেখে অন্য কিছু ভেবে বসেনি তো?
নায়লা!
হুঁ।
খুব ঠাণ্ডা লেছে। শোবার আগে চা খাওয়াবে?
নায়লা নিঃশব্দে চা বানাতে উঠে গেল। চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে, জামন ছবি দেখছে। খুব মনযোগের সঙ্গেই দেখছে।
নায়লা বলল, প্রথম যেদিন উনার কাছে গেলাম উনি বললেন, সাভার থেকে কি যেন কিনবেন। জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন। তুমি রাগ করনি তো?
না। রাগ করব কেন? ও যাদের পছন্দ করে তাদের খুক আপন করে দেখে। তোমাকে খুব পছুন্দ করে।
আমাকে পছন্দ করে না। তোমাকে করে! আমি হচ্ছি ফাউ। দেখি ছবিগুলি।
ছবি সুন্দর এসেছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আলমের পাশে নায়লা দাড়িয়ে। নায়ল আলমের দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর আলম বা হাতে নায়লাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নায়লার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। কখন এই ছবি তোলা হল? আলম কখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল? মনে নেই তো। কি সুন্দর হয়েছে ছবিটা! কি সুন্দর। নায়লা চোখ ফেরাতে পারছে না।
নায়লা।
হুঁ।
আলম তোমাকে কাল হোটেলে যেতে বলেছে।
নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল, আমাকে তার হোটেলে যেতে বলবে কেন? এটা কেমন কথা–শুনতেও তো খারাপ লাগছে!
তার বিয়ের তারিখ-টারিখ ঠিক করবে। বিয়ের জিনিসপত্র কিনবে। ও সামনের সপ্তাহেই বিয়ে করতে চায়।
সামনের সপ্তাহেই করুক বা আগামীকালই করুক, তিনি তো আমাকে বলতে পারেন না। হোটেলে যেতে ব্যাচেলার একজন মানুষ, একা থাকেন …
তুমি হঠাৎ রেগে গেলে কেন? ওর মনে কিছু নেই বলেই ও এতো সহজে বলতে পারল। এটা তুমি কেন বুঝতে পারছ না? তাছাড়া এমন তো না যে তুমি তার হোটেলে যাওনি!
আমি গোপনে গিয়ে উপস্থিত হইনি। কাছে গিয়েছি।
সেও তোমাকে গোপনে যেতে বলছে না। জরুরী কাজেই ডেকেছে।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, আমাকে তোমার বন্ধু হোটেলে ডেকে পাঠাচ্ছেন–আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি–দরজা বন্ধ করে জরুরী আলোচনা করছি–এটা তুমি সহজভাবে নেবে?
হ্যাঁ নেব। আলমকে আমি চিনি।
একজন স্বামীই কখনো তার স্ত্রীকে চিনতে পারে না আর তুমি ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনে ফেলবে। তুমি কতটুকু জান কে?
অনেকখানিই জানি।
না, তুমি অনেকখানি জান না। তুমি জান না যে ঐ লোক আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে।
জামান সহজভাবে বলল, তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে?
সরাসরি বলেনি, ইশারায় বলেছে।
তুমি যাকে ইশারা ভাবছ তা হয়ত ইশারা নয়।
তোমার ধারণা আমি এতই কম বুদ্ধির একটা মেয়ে যে কেউ আমার প্রেমে পড়তে পারে না?
তুমি শুধু শুধু রাগছ। আলম তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। ঠাট্টাটাই সত্য ভেবে তুমি কষ্ট পাচ্ছ।
ঠাট্টা হলে তো ভালই। চল ঘুমুতে যাই।
দুজন দুপাশে আর বাবু মাঝখানে শুয়ে আছে। একটা জানালা মনে হচ্ছে খোলা। বাতাস আসছে। নায়লার উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না। সে জেগে আছে। তবে পড়ে আছে মরার মত। তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে সে ঘুমুচ্ছে।