বল্টুটা কে?
স্কুল জীবনের বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেণ্ড। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বেঁটেখাট ছিল–আমরা বল্টু ডাকতাম। হঠাৎ লম্বা হওয়া শুরু করলো–দেখতে দেখতে তালগাছ। তখন তার নাম হয়ে গেলো স্ক্রু ড্রাইভার। তবে ঐ নাম স্থায়ী হল না। আগের নামটা রয়ে গেল।
নায়লা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেলো। জামানও আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে। এস, আলমের গল্প বলতে তার ভাল লাগছে।
তারপর হল কি–আমি তো হোটেলে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি পুরোদস্তুর এক সাহেব। সেই সাহেব আর কেউ না, আমাদের বন্দু।
বল্টু না, স্ক্রু ড্রাইভার।
ও হ্যাঁ, ক্রু ড্রাইভার। তের বছর পর ব্যটিাকে দেখলাম–আই এ পরীক্ষায় ফেল করে পালিয়ে গিয়েছিল।
কোথায় পালিয়ে গিয়েছিল?
কোথায় আমরাও জানতাম না। একদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি, ছবি ছাপা হয়েছে শেষের পাতায়–সাবেহ আলম সাইকেলে করে বিশ্ব পর্যটনে বের হয়েছে। ভাঙা লক্কড় একটা সাইকেলে সাইনবোর্ড লাগানো–S. Alam World Tour. বন্টুর গলায় একটা ফুলের মালা হাসি হাসি মুখ।
মজার মানুষ তো!
মজার তো বটেই। সে যে বিশ্ব ভ্রমণে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কিছুই বলে নাই–তার আত্মীয়-স্বজনদেরও কিছু বলে নাই। খুবই ইরেসপনসিবল টাইপের ছেলে। এই দেখ না, ঢাকায় সে এসেছে, দেশের বাড়িতে যায়নি। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজও নেয়নি। হোটেল বসে আছে।
উনার মার সঙ্গেও দেখা করেননি?
মার সঙ্গে দেখা করবে কি? মা-কি বেঁচে আছে?
বাবুর খেলনা উনি কিনে দিলেন?
হুঁ। কেউ যে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে খেলনা কিনতে পারে তাই জানতাম না। আশ্চর্য!
তুমি নিষেধ করলে না?
বন্দুকে নিষেধ করব আমি? আমার নিষেধ সে শুনবে? বন্টুর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি বলে এমন কথা তুমি বলতে পারলে–ওকে কাল নিয়ে আসব।
নায়লা চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো। মাসের শেষের দিকে গেস্ট আনার মত অবস্থাঁ কি আছে? ছেলেবেলার বন্ধু এলে একবেলা তো খাওয়াতেই হবে। ভালমত খাওয়াতে হবে। পোলাও-টোলাও করতে হবে। বাবুকে এ মাসে দুবার ডাক্তার দেখাতে হল। হাত এক্কেবারে খালি। ওর কাছে টাকা চাইতে হবে। ওই-বা কোথায় পাবে।
নায়লা, খুব সিম্পল খাওয়ার ব্যবস্থা করবে–ভাজি-ভুজি, টাকি মাছের ভর্তা ফর্তা, শুটকি, পারবে না?
পারব। উনি করেন কি?
কি করে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। থাকে সিয়াটলে তবে প্রচুর পয়সা করেছে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্যে। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরবে।
বউ পেয়েছেন?
আসলই তো মাত্র পরশুদিন। এর মধ্যে বউ কোথায় পাবে? বউ তো আর দোকানে সাজানো থাকে না। হা হা হা…
সাজানো থাকলেই তোমার বন্ধুর জন্যে ভাল হত। দেখে-শুনে পছন্দসই কিনে নিতে পারতেন। পছন্দ না হলে এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিয়ে নতুন একজন …।
জামান বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কি ধরনের কথা?
ঠাট্টা করছি।
আজেবাজে ধরনের ঠাট্টা করবে না। চা দাও দেখি–চা খাব।
এখন চা খাবে? চা খেলে তো তোমার ঘুম হয় না।
কাল ছুটির দিন আছে। ঘুম দেরিতে এলেও ক্ষতি নেই।
টেবিল পরিষ্কার করে তারপর দেই।
আচ্ছা।
নায়লা শোন, দুধ-চিনি ছাড়া শুধু লিকারে এক কাপ চা দাও। লিকারের চা শরীরের জন্যে ভাল।
আচ্ছা।
চা বানিয়ে এনে নায়লা দেখে জামান নিজেই মুগ্ধ হয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে খেলছে। শিশুরাও এত মুগ্ধ হয়ে কোন খেলনা নিয়ে খেলে না। নায়লাকে দেখে সে লজ্জিত মুখে বললো, ইন্টারেস্টিং, তাই না?
হুঁ।
সামান্য খেলনা, অথচ কি করেছে! সবই ইলেকট্রনিক্স। সায়েন্স কোথায় চলে যাচ্ছে। ঘরে পান আছে?
আছে।
চা খাবার পর পান খাব। কাল মিষ্টিপানের ব্যবস্থা রেখো তো নায়লা–বন্টুর আবার দেখি পান খাবার অভ্যাস হয়েছে। একসঙ্গে দুটা মিষ্টিপান মুখে দিয়ে কচকচ করে চিবোচ্ছে।
উনি দেখতে কেমন?
ছোটবেলায় বেকুপ টাইপ চেহারা ছিল। এখন রাজপুত্রের মত। যে কোন সিনেমায় তাকে হিরোর পার্ট দেবো।
জামানের চা খাওয়া হয়েছে, পানি খাওয়া হয়েছে। রাত প্রায় বারোটার মত বাজে। এখন ঘুমুতে যাওয়া দরকার। জামানের ঘুম আসছে না। স্ত্রীর সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছা করছে। খুব অন্তরঙ্গ কিছু সময়। গোপন ইচ্ছাটা নায়লাকে কি ভাবে বলবে তাও বুঝতে পারছে না। লুজ্জালজ্জা লাগছে। এই সমস্যাটা তাকে খুব বিরক্ত করে। অন্য স্বামীদের এই সমস্যা হয় কিনা কে জানে।
নায়লা বলল, শুবে না?
জামান অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ঘুম আসছে না। চা খাওয়াটা বোধহয় ঠিক হয় নি। বাজে কটা?
বারোটা পাঁচ।
ও, রাত তো অনেক হয়ে গেলো। চল ঘুমুতে যাই।
বলেও জামান বসেই রইলো। তার এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে নায়লার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। তার ভয় হচ্ছে, সে তাকালেই নায়লা বুঝে ফেলবে কেন তার ঘুম আসছে না।
নায়লা।
উঁ।
খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো।
খুব ঠাণ্ডা পানি তো পাব না। সাধারণ এক গ্লাস পানি দেই?
আচ্ছা দাও। ফিরুর মা কি শুয়ে পড়েছে?
হুঁ। কেন?
না এম্নি।
জামানের কেমন জানি উদাস উদাস লাগছে। মনে হচ্ছে মুখ ফুটে আজ রাতে সে স্ত্রীকে কিছু বলতে পারবে না।
নায়লা তাকে পানি দিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেছে–তুমি বসে থাকে। আমি আসছি। বলতে বলতে ঠোটের ফাঁকে একটু যেন হাসলো। এর মানে কি? সে কি কিছু বুঝে ফেলল? বুঝে ফেললে খুব অস্বস্তির ব্যাপার হবে। শুধু অস্বস্তি না, লজ্জাও।
নায়লা শোবার ঘরে এসে নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল। মানুষটার এত লজ্জা কেন? সে কি বাইরের কেউ? অনেক দূরের কেউ যাকে মুখ ফুটে কিছুই বলা যাবে না? নায়লা খুব সাবধানে স্টীলের আলমিরা খুলে টকটকে লাল রঙের শাড়ি বের করলো। ঠোটে লাল করে লিপিস্টিক দিল। কপালে টিপ দিল। চুল পিঠে ছড়িয়ে দিল। কাজল বানানো নেই। কাজল থাকলে সুন্দর করে চোখে কাজল দেয়া যেতো। মানুষটা কাজল খুব পছন্দ করে। বিয়েবাড়ি-টারি কোথাও যেতে হলে সে একবার না একবার বলবেই–নায়লা কাজল দিয়েছ? যেন সাজসজ্জার একটাই বিষয়–কাজল। আজ সে দারুণ একটা সাজ করে মানুষটাকে বলবে–দেখ তো কেমন লাগছে?