নায়লা ভেবে পাচ্ছে না আরুনার উপর তার এত রাগ হচ্ছে কেন! অরুণার উপর রাগ করে এমন খারাপ খারাপ কথাই বা কেন মনে আসছে? আলম বুলল, খাওয়ার পর
আপনার গান শুনব।
সর্বনাশ! আমার গান শুনলে এই এ্যাপার্টমেন্টের লোকজন আমাকে রাস্তায় বের করে দেবে।
নায়লা মনে মনে বলল, তোকে রাস্তায় বের করবে না, তোকে কানে ধরে স্টেডিয়ামে চক্কর দেয়াবে। তামুঙ্গেশগিরি বের করে দেবে।
আলম বলল, আপনার কোন অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না। খাওয়ার পর শুরু হবে সংগীত। স্পেনিশরা কি করে জানেন? যে কোন পার্টির পর নাচতে শুরু করে, নাচ চলে একেবারে মধ্যরাত পর্যন্ত।
নায়লা মনে মনে বলল, তুই বসে আছিস কেন? তুই বল আমি স্কুলের ফাংশানে নেচেছি। আপনি চাইলে এখানেও নাচব।
বাবু উঠে গেছে। উঠেই কান্না। জামান খাওয়া বন্ধ রেখে ছেলেকে ধরল। ছেলে ব্যাকুল হয়ে বলল, বাবা, আমি বাতিস দুদু খাব না? এত দীর্ঘ একটা বাক্য ছেলে এই প্রথম বলল। জামানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ছেলেকে নিয়ে ছাদে হাঁটতে গেল।
আলম বলল, বাচ্চা-কাচ্চা খুব ভাল জিনিস, কিন্তু এদের জন্যে যে খাওয়া রেখে উঠে যেতে হয়, গল্পের আসর ফেলে কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়, এটা খারাপ। বাচ্চাকাচ্চা কেমন হওয়া উচিত জানেন অরুণা? বাচ্চাকাচ্চা হওয়া উচিত চাবি সিস্টেমে। চাবি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন–আবার যখন আদর করতে ইচ্ছা করল চাবি দিয়ে জাগিয়ে খানিকক্ষণ আদর করলেন।
অরুণা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেল! নায়লা ভাবল–এই মেয়েটা নিতান্ত বেহায়ার মত হাসছি। বোঝাই যাচ্ছে বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে আছে। লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়েছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে অরুণা সত্যি সত্যি গান গাইতে বসল। নায়লা মেয়েটার নির্লজ্জতায় হতভম্ভ হয়ে গেল।
আপনারা কিন্তু আমার গান শুনে মুখ টিপে হাসতে পারবেন না। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেও পারবেন না–ভাল হয়েছে।
নায়লা মনে মনে বলল–ঢং করিস না বারি কোথাকার! গান গাইতে বসেছিস, গেয়ে ফেল। গানের শেষে তুই একটা খ্যামটা নাচও দেখাবি। আলম তোর খ্যামটা নাচও পছন্দ করবে।
অরুণা বলল, আমি কি একটা রবীন্দ্র সংগীত করব?
আলম বলল–আপনার যা ইচ্ছা করুন। শুধু দয়া করে খেয়াল ধরবেন না।
অরুণা আবারও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নায়লার ইচ্ছা করছে বলে–তুই যে ভাবে হাসছিস তোর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
অরুণা গান শুরু করেছে–
আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।
অরুণার গলা মিষ্টি। গাইছেও খুব সুন্দর করে। নায়লা বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে। অরুণা এতো সুন্দর গাইতে পারে নায়লার জানা ছিল না।
গান শেষ করে অরুণা হালকা গলায় বলল, বাবার খুব শখ ছিল আমি গান শিখি। মাস্টার টাস্টার রেখে হুলস্থূল করেছিলেন। বাবা মারা গেলেন, গনিও মারা গেল। দশ বছর পর প্রথম একটা পুরো গান গাইলাম।
আলম বলল, অসাধারণ আপনার গলা। নায়লা, অসাধারণ না?
নায়লা বলল, হ্যাঁ।
আলম বলল, আমরা কি আরেকটা শুনতে পাব?
অরুণা বলল, হ্যাঁ পাবেন। এবং এইটাই শেষ। আর কোন গানই আমি পুরো জানি। অরুণা আবার শুরু করল —
মধুর, তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ।
নায়লা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–তার কত শখ ছিল গান শেখার। স্কুলের আপা বলেছিলেন–নায়লা, তুই মন দিয়ে গান শেখ, তুই নাম করবি–তোর গলা ভাল। সেই ভাল গলা দিয়ে তার লাভটা কি হল? বাবাকে সে গানের স্যার রাখার কথা বলতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—স্যার রেখে গান শিখতে হয় না-কি? রেডিও শুনে শুনে শিখবি। যে শিখতে পারে সে রেডিও শুনে শুনে শিখতে পারে। যে পারে না তাকে মাস্টার গুলে খাওয়ালেও পারে না।
আলম বলল, নায়লা, তুমি গান জান না? নায়লা কঠিন গলায় বলল, না।
গুন গুন করে গাওয়ার মত খানিকটা নিশ্চয়ই জান। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াও না? না-কি ঘুম পাড়াবার দায়িত্ব বাচ্চার বাবার?
নায়লা বলল, আমি রান্না আর ঘর ঝাট দেয়া ছাড়া আর কিছু জানি না। ঘর কি করে কাঁট দেয়া হয় দেখতে চাইলে ব্র আঁট দিয়ে দেখাতে পারি।
আচ্ছা বেশ, আমরা তাই দেখব। নিয়ে আস ঝাড়ু?
অরুণা আবার হেসে উঠল খিলখিল করে। নায়লার এমন রাগ লাগছে।
বাবু খুব কাঁদছে। ফেঁপাতে ফেঁপাতে ডাকছে, মাম্মাট মাম্মাট।
আলম বলল, নায়লা, তুমি বাবুর কাছে যাও তো। সে তোমার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। আমরা এখন বিদেয় হব। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি তাকে ঠিকমত নামিয়ে দেব। আরেকটা কথা, তোমার বান্ধবীর সামনেই বলছি–তোমার বান্ধবীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। শ্রামার প্রসঙ্গে তোমার বান্ধবীর মনোভাবটা কি জানতে পারলে ভাল হত। তিনি কি বলবেন?
অরুণা মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
নায়লা মনে মনে বলল, বাদরি, তুই এত ঢং কোথেকে শিখেছিস? চিৎকার করে বলে ফেল–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এক্ষুণি চাই। এক্ষুণি চাই। সিনেমার নায়িকার মত তুই ঢং করছিস কেন রে ঢঙ্গি? এর মধ্যে ঢং করার কি আছে? কি কুৎসিত কথা সে অরুণাকে নিয়ে ভাবছে! অথচ অরুণা এত ভাল একটা মেয়ে। নায়লার কি হয়েছে? কেন সে এত খারাপ হয়ে গেছে?
নায়লা শোবার ঘরে বাবুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। সারাদিন বাবু আজ মাকে কাছে পায়নি। সে দুহাতে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমরা চলে গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যাবার আগে নায়লার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নেয়নি।