জ্বি।
বোস, চা খাও। আমি নিজেই বানাব। উপায় কি?
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হোক না একটু দেরি। কি হয় সামান্য দেরিতে? আমাকে তো আর বেশিদিন পাবে না। হঠাৎ একদিন শুনবে —শেষ। গেম ইজ ওভার। তখন নিজেই আফসোস করবে– আহা! বেচারা বুড়ো মানুষ! বসতে বলেছিল, বসলাম না। আমার অবস্থা এখন খুব খারাপ। কেউ এখন আর আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। নুরুকে ডাকলে ও কি করে জান? ধর আমি ডাকলাম, নুরু! নুরু! সে মিষ্টি করে বলবে, আসছি বাবা। বলেই অন্য দরজা দিয়ে রাস্তায় চলে যাবে। দিস ইজ মাই লাইফ। বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রী বসে কুটকুট করে গল্প করে এমন একটা কথা শোনা যায়। আমার কপালে তাও নেই। ধর কোন একটা জরুরী কথা তোমার শাশুড়িকে বলতে চাচ্ছি। আমি মুখ খোলার আগেই তোমার শাশুড়ি বলবেন–চুপ কর। কথা শুরুর আগেই চুপ কর। আরে জীবনটাই তো চুপ করে করে কাটিয়ে দিলাম। ঠিক বলছি না?
জ্বি।
মরার পর যদি কোন কারণে আমার বেহেশতে স্থান হয় আমি কি চাইব জান?
কি চাইবেন?
আমি চাইব তোমার শাশুড়ি আমার সামনে বসে থাকবে, আর আমি ক্রমাগত কথা বলে যাব। সে শুধু শুনবে। কখনো বলতে পারবে না, চুপ কর। আমার কথা ভাল লাগুক আর না লাগুক তাকে শুনতে হবে। She must listen.
জামান ছাড়া পেল রাত আটটায়। শসা কিনে বাসায় পৌছতে পৌছতে আটটা পনেরো। তার অস্বস্তির সীমা রইল না। নায়লা রাগ করবে। রাগ করাটা স্বাভাবিক। সবার সামনে হৈ-চৈ শুরু না করলেই হয়।
অতিথি দুজনই এসেছে। বসার ঘরে আলম গল্প করছে অরুণার সঙ্গে। আলম সত্যি সত্যি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। অরুণ পরেছে বাটিকের কাজ করা রাজশাহী সিল্ক। অরুণা এম্নিতেই সুন্দর। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। নায়লা রান্নাঘরে। পোলাও বসিয়েছিল–পোলাও নষ্ট হয়ে গেছে। পুড়ে একাকার। আবার নতুন করে পোলাও চড়িয়ে সে হাঁড়ির কাছে পঁড়িয়ে। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। সে কাপড় বদলায়নি। কাজলদানি খুঁজে পাওয়ায় শুধু চোখে কাজল দিয়েছে। সেই কাজলও ভাল হয়নি, লেপ্টে গেছে।
জামান রান্নাঘরে শসা রাখতে রাখতে বলল, খুব দেরি করে ফেললাম!
নায়লা জবাব দিল না। শুধু কঠিন চোখে তাকাল। জামান বলল, রান্না হয়নি?
রান্না নিয়ে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শাড়ি এনেছ?
নুরু বাসায় ছিল না।
গ্রীন ফার্মেসীতে খোঁজ করেছিলে?
না।
ও বাসায় কতক্ষণ থাকে? ও তো দিনরাত গ্রীন ফার্মেসীতে পড়ে থাকে। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ নেবার কথা মনে পড়ল না? সামান্য বুদ্ধিটাও তোমার হয় না? বুদ্ধি জমা রেখে রেখে হবেটা কি?
সামান্য ব্যাপারে এত রেগে যাচ্ছ কেন?
আমার সবই তো সামান্য। রান্নাঘরে গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকবে না। যাও, ওদের সঙ্গে বোস। না থাক, এদের সঙ্গে বোসতে হবে না। বাবুর কাছে যাও।
জামান চলে যেতেই ফিরুর মা বলল, স্বামী হইল গিয়ে আম্মা বেহেশতের চাবি। বেহেশতের দরজার মধ্যে বাইশ হাত লম্বা এক তালা ঝুলছে। স্বামী হইল হই তালার চাবি। কোন মেয়েছেলে বেহেশতে ঢুকনের আগে হেই চাবি দিয়ে দরজা খুলন লাগে। এই জন্যে স্বামীর সঙ্গে খারাপ কথা বলা কিতাবে নিষেধ।
ফিরুর মা, তোমার মুখটা দয়া করে তালাবন্ধ করে রাখ একটা কথা না।
জ্বাল কমাইয়া দেন আম্মা–পোলাও মরম হইব।
পোলাও নরম হবে না শক্ত হবে সেটা আমি দেখব। তোমার বক্তৃতা দিতে হবে না।
নায়লা রাগ করেই আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দিল। তার কান্না পাচ্ছে। আজ সবকিছু এমন খারাপভাবে এগুচ্ছে কেন?
অরুণার উপর তার ভয়ংকর রাগ লাগছে। যদিও রাগ লাগার তেমন কোন কারণ নেই। মেয়েটাকে আজ প্রচণ্ডরকম বেহায়া মনে হচ্ছে। ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে কী করে রেখেছে। অন্য সময় তো এত লাল লিপস্টিক দিতে দেখা যায় না। আলমের প্রতিটি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এই মেয়ের পেটে এত হাসি লুকানো ছিল? রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের কথাবার্তা সবই শোনা যায়। নায়লা খুব মন দিয়ে শুনছে। এমন কিছু হাসির কথা তো আলম বলছে না। তাহলে এত হাসি কেন? কিশোরী মেয়েরা খিল খিল করে হাসলে মানায়। তুই এক ধামড়ি, তুই এমন করে হাসছিস কেন? সুন্দর ছেলে দেখে হুস নেই?
নায়লা রান্নাঘরে আটকে আছে। তার কি উচিত ছিল না একবার এসে খোঁজ নেয়া? ভদ্রতা করেও তো বলতে পারতো–তোর কি সাহায্য লাগবে বল। ভদ্রতাটতা এখন এই মেয়ে গুলে খেয়ে বসে আছে। কেউ বোধহয় তাকে বলে দিয়েছে। খিলখিল করে হাসলে ছেলেরা খুশি হয়। সে হেসেই যাচ্ছে। নায়লার ইচ্ছে করছে বলে আসে–আস্তে করে হাসো। বাবু উঠে যাবে।
সবাই খেতে বসল রাত নটায়। অরুণা বলল–এত রাত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে। কি সর্বনাশের কথা! আলম বলল, কেন সর্বনাশের কথা না। আনন্দের কথা। আমরা এই আসর ভাঙব রাত বারোটায়। আপনার ভয় নেই। আপনাকে আমি পৌঁছে দেব।
বারোটার সময় বাসায় পৌঁছে দিলে আমাকে স্ট্রেট বাসা থেকে বের করে দেবে। আমি হব পথবাসি।
নায়লার গা জ্বলে গেল–কি কাব্য! আমি হব পথবাসি! আলম বলল, আমরা থাকতে আপনি পথবাসি হবেন না। আচ্ছা অরুণা, শুনুন, আপনি কি গান জানেন?
উহুঁ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি গান জানেন।
স্কুলের ফাংশানে গাইতাম–না জানার মতই।
নায়লার মুখ তেতো হয়ে গেল। স্কুলের ফাংশানে গাইতাম! তুই স্কুলের ফাংশানে গান গেয়ে সবাইকে উদাস করে দিয়েছিস! লতামুঙ্গেশকর এসেছে।