নায়লা অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি উঠি?
একটু বোস নায়লা। প্লীজ। এক মিনিটের জন্য বোস।
নায়লা বসে আছে। তার হাত-পা শির শির করছে। কপাল ঘামছে।
নায়লার অসম্ভব মাথা ধরল
সন্ধ্যার আগে আগে নায়লার অসম্ভব মাথা ধরল।
মাথা তো ধরবেই–একের পর এক সমস্যা হচ্ছে। নুরু টাকা নিয়ে গেছে কিন্তু, শাড়ি দিয়ে যায়নি। অথচ এই শাড়ি পরার জন্যে সে রেডিমেড় ব্লাউজ কিনে এনেছে। ইস্ত্রি করিয়ে রেখেছে।
চোখে কাজল দেবে, কাজলদানি খুঁজে পাচ্ছে না। ফিরুর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে বলল, আমি তো আম্মা চউক্ষে কাজল দেই না। আমি কই ক্যামনে?
চোখে কাজল দাও না বলে কাজলদান কোথায় তুমি জানবে না?
জ্বে না। যার জিনিস হে খুঁজ রাখব।
রাগে নায়লার শরীর কাঁপছে। সে রাগ সামলাতে পারছে না। তিনতলার বাসা থেকে চারটা দামী গ্লাস এনেছিল, একটা ভেঙে গেল। সে নিজেই ভাঙল। রান্নাঘর থেকে ফিরুর মা বলল, আল্লা বাচাইছে, আফনের হাতে ভাঙছে, আমার হাতে ভাঙলে আইজ গজব হইত।
চুপ কর ফিরুর মা।
চুপ কইরাই তো আছি গো আম্মা ফিরু মরণের পর থাইক্যা…
আর একটা কথা বললে তোমাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব—
দেন ফেলাইয়া। ফিরু মরণের পর থাইক্যা বাইচা খাকতে ইচ্ছা করে না।
এই পর্যায়ে নায়লার মাথা ধরল। রান্নাবান্নাও তখনো শেষ হয়নি। মাংস সিদ্ধ হচ্ছে। যত জ্বাল হচ্ছে মাংস মনে হয় ততই শক্ত হচ্ছে।
বাবু বিকেল থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছে–বাতিস দুদু। বাতিস দুদু। নায়লা ঠিক করেছে তাকে আর বুকের দুধ দেয়া হবে না। কাদুক যত ইচ্ছা। কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে ফেলুক।
জামান বাবুকে নিয়ে তখন থেকেই ছাদে ইটছে। গল্প বলে শান্ত করার চেষ্টা করছে। যতক্ষণ গল্প বলে ততক্ষণ বাবু শান্ত হয়ে শুনে। গল্প শেষ হলেই মাম্মাট বাতিস দুদু। মাম্মাট বাতিস দুদু। জামান গল্পের পর গল্প বলে যাচ্ছে। গল্পগুলি বাবু বুঝতে পারে কিনা কে জানে। যে ভাবে শুনে তাতে মনে হয় বুঝতে পারছে। অথচ বুঝতে পারার কোন কারণ নেই। জামান নতুন গল্প শুরু করল—
বাবু, কি হয়েছে শোন। আমার না চাকরি চলে গেছে। আর আমাকে অফিসে যেতে হবে না। মজা হয়েছে না? এখন শুধু তোমার সঙ্গে খেলব। তবে মাসের শেষে কোন টাকা আসবে না–এইটাই সমস্যা।…
এই জরুরী গল্প জামান এখনো নায়লাকে বলতে পারেনি অথচ বলা দরকার। সে ঠিক করেছে আজ রাতেই বলবে। বাবু যত শান্ত হয়ে শুনেছে নায়লা কি শুনবে? কেঁদেকেটে অস্থির হবে। নায়লা একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতে পারে না।
বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতিস দুদু পাওয়া যাবে না, এই ব্যাপারে হতাশ হয়েই বোধহয় ঘুমুচ্ছে। বড় মায়া লাগছে জামানের। ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সারাজীবন সে ছেলে কোলে নিয়ে ছাদে হাঁটতে পারবে।
নায়লা ছাদে এসে বলল, বাবু কি ঘুমুচ্ছে?
হুঁ।
ঘুমুচ্ছে, শুইয়ে দিচ্ছ না কেন? ছাদে নিয়ে হাঁটাহাটি করে ঠাণ্ডা লাগাবে নাকি? শুইয়ে দাও। আর শোন–কাচা বাজার থেকে শসা এনে দাও। শসা আনতে ভুলে গেছি।
আচ্ছা।
আমার শাড়িটা নিয়ে নুরুর আসার কথা, ও তো এলো না। তুমি কি মার বাসা হয়ে আসবে?
আচ্ছা যাব।
রান্নাই এখনো শেষ করতে পারিনি। কখন কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। প্রচণ্ড মাথাও ধরেছে। এত অস্থির লাগছে।
সামান্য ব্যাপারে এত অস্থির হয়ো না।
নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল–তোমার কাছে এই ঝামেলাগুলি সামান্য মনে হচ্ছে? আশ্চর্য–!
নুরুর কাছে শাড়ির খোঁজে যাওয়া অর্থহীন। তবু জামান শ্বশুরবাড়িতে গেল। নুরুকে পাওয়া গেল না। শাড়ির ব্যাপারে বাসায় কেউ কিছু জানে না। জামানের শাশুড়ি সঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গাল ফুলে একাকার। জামাইয়ের সঙ্গে কোন কথা বলার তার অবস্থা নেই। জামানের শ্বশুর মোর্তজা সাহেব এম্নিতেই কথা বেশি বলেন। রিটায়ারমেন্টের পর থেকে কথা বলাই তার একমাত্র কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ বাড়িতে এলে তার আনন্দের সীমা থাকে না। কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল। জামানকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। কারণ জামান মন দিয়ে কথা শুনে, কথার মাঝখানে বিরক্ত করে না।
মোর্তজা সাহেব বললেন, জামান বাবা, কেমন আছ?
জি ভাল।
বাবু কেমন আছে?
ভাল।
বাবু নামটা বদলে দাও। বাবু বিবি এগুলো নাম হল-–? নাম হতে হয় সুন্দর, ভদ্র, শোভন। নামের মধ্যে অনেক কিছু প্রতিফলিত হয়। বাবা-মার রুচি, পরিবারের সামগ্রিক শিক্ষার মান। বোস না, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আজ চলে যাই। বাসায় কয়েকজনকে দাওয়াত করেছি।
দাওয়াত করেছ, এসে খেয়ে যাবে। পাঁচ মিনিট আগে খেতে, এখন খাবে পাছ মিনিট পরে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?
জি না।
পড়বে। কাগজটা মন দিয়ে পড়বে। যা লিখে সবই মিথ্যা, তবু মিখ্যার ফাক দিয়ে কিছু কিছু সত্য বের হয়ে আসে! সত্য হচ্ছে আলোর মত। গোল আলু ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় কিন্তু সত্যের আলো রাখা যায় না। ফাঁক-ফোক দিয়ে কিছু বেরিয়ে আসবেই। বোস–চা খাও।
সালাদের জন্যে শসা কিনে বাসায় যেতে হবে।
একদিন সালাদ না খেলে কিছু হবে না। মানুষ তো আর ঘোড়া না যে প্রতিদিন কাচা ঘাস, লতাপাতা খেতে হবে। বোস তো।
জামান বসল। মোর্তজা সাহেজ বললেন, কাজের লোক বিদেয় হয়ে গেছে। তোমার শাশুড়ির এই অবস্থা। ব্যথা যতটুকু না চিৎকার শুনলে মনে হবে কি না কি হয়ে গেল। আরে বাবা, বয়স হয়েছে, এখন দাঁতের ব্যারাম হবে, বুক ধড়ফড় করবে, এসিডিটি হবে–দিস ইজ লাইফ। কি বল জামনি?