আলম বাথরুম থেকে শীষ দিতে দিতে বের হল। সুন্দর পোশাক পরেছে। ধবধবে শাদা প্যান্টের সঙ্গে হালকা লাল গেঞ্জি। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আলমকে। পোশাক মানুষকে অনেকখানি পাল্টায়। সুন্দর পোশাকে জামানকেও নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। জামান সারাজীবন পরল পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বুড়োরা। সে কি বুড়ো হয়ে গেছে? নায়লার ইচ্ছা করছে জামানের জন্যে একটা শাদা প্যান্ট এবং হালকা লাল রঙের গেঞ্জি কিনতে। নিশ্চয়ই আকাশ-পাতলি দাম।
আলম বলল, নাও, কফি নাও। চুপচাপ বসে আছ কেন?
ভাবছি।
কি ভাবছ?
আপনি আমাকে দেখে একেবারেই অবাক হন নি কেন তাই ভাবছি।
অব্যাক হব কেন? ঢাকা শহরে আমি চিনি তোমাদের দুজনকে। তোমরা আমার কাছে আসবে, এতে আমি অবাক হব কেন? না এলে অবাক হওয়ার একটা ব্যাপার থাকতো।
কি জন্যে এসেছি তাও তো জিজ্ঞেস করলেন না!
তুমি নিজেই বলবে, এটা জানি বলেই জিজ্ঞেস করিনি। বল কি জন্যে এসেছ।
আজ রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।
ফাইন। খাব।
আমি অরুণাকেও আসতে বলেছি।
অরুণাটা কে?
কি আশ্চর্য! অরুণা কে তাও ভুলে গেছেন?
ও আচ্ছা, আচ্ছা। মনে পড়েছে। অরুণা হচ্ছে তোমার রূপবতী বান্ধবী। যার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা চেষ্টা তুমি চালাচ্ছ।
হুঁ। অরুণা আসবে। তাকে দেখতে পারবেন। তার সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন।
খুবই ভাল ব্যবস্থা। আমি যথাসাধ্য সেজেগুজে যাব। কি পরলে ভাল হয় বল তো?
যা পরে আছেন সেটাই তো ভাল। মোটেই না। এই পোশাকে আমাকে স্মার্ট দেখাচ্ছে। প্রেম করার জন্যে মেয়েরা স্মার্ট ছেলে খুঁজে, বিয়ের জন্য পছন্দ করে শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে। সেই সব ছেলেদের পোশাক হচ্ছে পায়জামা-পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল। এরা হাঁটবে মাটির দিকে তাকিয়ে। হাসবে লাজুক ভঙ্গিতে। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
আপনি সেই রকম একটা ছেলে সেজে আমাদের বাসায় যাবেন?
অবশ্যই। আমার কোন পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। তুমি আমাকে পায়জামাপাঞ্জাবি কিনে দেবে।
আমি?
হ্যাঁ তুমি। আকাশ থেকে পড়লে বলে মনে হয়। এই দেশে কি পায়জ্জামা-পাঞ্জাবি কেনা অপরাধ বলে গণ্য করা হয়?
আমাকে বাসায় যেতে হবে। রান্নাবান্না কিছু করিনি। আমি বাজারে যাব। বাজার করব। কোট-বাছা হবে, রান্না হবে, তারপর আপনারা খাবেন।
আমরা না হয় আজ রাতে একটু দেরি করে খাব। ওঠ। আমি বেশি সময় নেব না। পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনতে আমার সময় লাগবে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট কফি শপে কফি খাব, তাতে যাবে আরো পনেরো মিনিট। সব মিলিয়ে কুড়ি মিনিটের মামলা।
কফি তো এই মাত্র খেলেন।
এটা হল হোটেলের কফি। হোটেলের কফি কোন কফি নয়। তা ছাড়া তুমি এসেছ–আমি খুশি হয়েছি। এই খুশির একটা প্রকাশ থাকবে না?
আমাকে কফি খাইয়ে সেই খুশির প্রকাশ দেখাবেন?
হ্যাঁ।
কফি আমার দু চক্ষের বিষ।
সেটাও বুঝতে পারছি। তুমি কাপে সর্বসাকুল্যে দুবার চুমুক দিয়েছ। চল আইসক্রীম খাব।
এই বয়সে কেউ আইসক্রীম খায়?
আইসক্রিম হল চুমুর মত। চুমু খাবার যেমন কোন বয়স নেই–আইসক্রীম খাবারও নেই।
নায়লা হকচকিয়ে গেল। এইসব কথা এমন করে কেউ বলে?
দুপুরবেলাতেও আইসক্রীম শপে মানুষ গিজ গিজ করছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার। চারদিক ঝকঝক তকতক করছে। মিষ্টি গান হচ্ছে। নায়লাকে কোণার দিকের একটা টেবিলে বসিয়ে আলম আইসক্রীম আনতে গেল।
নায়লার অস্বস্তি লাগছে। পরিচিত কেউ দেখে ফেলবে না তো? দেখে ফেললে কি কি ভাববে? তবে দেখা হবার সম্ভাবনা কম–তার আত্মীয়স্বজনরা সবাই গরীব। এমন কায়দার জায়গায় তারা আইসক্রীম খেতে আসবে না।
আলম আইসক্রীম নিয়ে ফিরছে। নায়লা ঠিক করে ফেলল, এই জায়গায় সে জামান এবং বাবুকে নিয়ে আইসক্রীম খেতে আসবে। যত টাকা লাগে লাগুক। প্রতিদিন তো আর আসবে না–জীবনে একবারই আসবে।
নায়লা, তোমার জন্যে বাটার নাটি এনেছি। দেখ তো কেমন লাগে। অনেকে আবার আইসক্রীমে বাদাম পছন্দ করে না। তোমার যদি ভাল না লাগে তাহলে বদলে দেব।
আমার ভাল লাগছে।
ভাল লাগলে হাসিমুখে খাও। এমনভাবে খাচ্ছ মনে হয় বিষ খাচ্ছ। গল্প করতে করতে খাও।
কি গল্প করব?
যা ইচ্ছা কর। কি গল্প করবে সেটাও কি বলে দিতে হবে?
আমি গল্প জানি না। বরং আপনি গল্প করুন। আমি শুনি।
আমার গল্প শুনতে কি ভাল লাগবে?
হ্যাঁ লাগবে।
কি গল্প শুনতে চাও বল।
ঐ যে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে পড়েছিলেন, সেই গল্পটা বলুন।
জামান তোমাকে বলেনি?
না। ও তো গল্প-টল্প করে না।
কি করে? অফিস করে আর বাসায় এসে ঘুমায়?
অনেকটা এরকম।
আলম বিরক্তমুখে বলল, জামানকে দোষ দিয়ে কি হবে? বেশির ভাগ মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি এই রকম। খাওয়া-ঘুম-খাওয়া, এই সাইকেলে শুধু ঘুরছে। বেঁচে থাকার মধ্যে যে একটা আনন্দের ব্যাপার আছে তা এরা জানে না। স্বপ্নহীন জীবন যাপন।
নায়লা কলল, ওদের কথা বাদ দিন, আপনার গল্পটা বলুন। আমার সত্যি শুনতে ইচ্ছা করছে।
আলম আইসক্রীম খাচ্ছে। কোন কথা বলছে না। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। আলমকে দেখে নায়লার কেমন জানি ভয়-ভয় লাগছে।
নায়লা!
জ্বি।
ঐ মেয়েটার নাম ছিল রেশমা।
জানি। আপনার বন্ধু আমাকে বলেছে।
ও যে দেখতে তোমার মত ছিল তা কি তোমাকে বলেছি?
নায়লা ক্ষীণ গলায় বলল, হ্যাঁ বলেছেন।
তুমি হাসলে গালে টোল পড়ে। রেশমা রাগলে তার গালে টেল পড়তো।