যেহেতু এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে, কাজেই তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে কোন বাধা নেই। সে মোটর সাইকেল নিয়ে এসে প্রায়ই নায়লাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। তার প্রধান কাজ ছিল ঘুরে বেড়ানো। মোটর সাইকেল নিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেত। একবার নিয়ে গেল জয়দেবপুরে ফরেস্টের এক বাংলোতে। নির্জন বাংলো। শুধু একজন কেয়ারটেকার এবং দারোয়ান। কেয়ারটেকার ঘর খুলে দিল। কাঠের বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। এত নির্জন চারদিক, নায়লার ভয় ভয় করছিল। রফিকুল ইসলাম চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল, বলল, কি খুকী, ভয় লাগছে (লোকটা তাকে মজা করে খুকী ডাকত)?
না।
ভয় করার কোন কারণ নেই। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসেছ! তাই না?
হুঁ।
আমরা এখানে রাত দশটা পর্যন্ত থাকব। তোমার বাবা-মাকে বলে এসেছি, কাজেই ওরা চিন্তা করবে না।
ডাকবাংলোয় রাত দশটা পর্যন্ত থাকব এটা বলে এসেছেন?
আরে না, পাগল হয়েছ? বাংলাদেশী বাবা মা ডাকবাংলো শুনলেই আঁৎকে উঠবেন। তাঁদেরকে বলেছি, তোমাকে নিয়ে আমার এক অসুস্থ খালাকে দেখতে যাব। ফিরতে দেরি হতে পারে, নস্টা-দশটা বাজবে। তাঁরা খুশি মনে বলেছেন, আচ্ছা।
সেই ডাকবাংলোয় তারা রাত দশটা না, রাত এগারোটা পর্যন্ত ছিল। নায়লা ডাকবাংলোয় তার অভিজ্ঞতার গল্প কাউকে বলেনি। বলা সম্ভবও নয়, এবং উচিতও নয়। তবে রফিকুল ইসলাম নামের সানগ্লাস পরা ঐ লোক ডাকবাংলোর গল্প নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে করেছে। ছেলেরা এই জাতীয় গল্প বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে করতে ভালবাসে। অনেকে স্ত্রীদের সঙ্গেও করে। কিছু কিছু স্ত্রী আছে স্বামীর মুখে এ জাতীয় গল্প শুনতে ভালবাসে। নায়লার দূর সম্পর্কের এক মামী আছেন–রাঙ্গামামী–তিনি সুযোগ পেলেই তাঁর স্বামীর এই ধরনের একটা গল্প শুনিয়ে দেবেন–বুঝলি নায়লা, বিয়ের আগে তোর মামা ছিল ভয়াবহ এক চীজ। মেয়েদের পটানোর সে এক হাজার একটা কৌশল জানে। কোন মেয়েকে তার মনে ধরেছে তো আর দেখতে হবে না। ঐ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে। তোর মামা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিছানাতে নেবেই। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল–একবার বিছানায় নেবার পর তোর মামার সব আগ্রহ শেষ। এই চ্যাপ্টার ক্লাজ–নতুন আরেক চ্যাপ্টার …।
রফিকুল ইসলাম নামের লোকটাও কি তার স্ত্রীর কাছে ইন্টারেস্টিং গল্প হিসেবে নায়লার গল্প করেছে? করেছে বলেই মনে হয়। গল্প করার মত অনেক কিছুই সেই ডাকবাংলোয় ঘটেছিল। রফিকুল ইসলাম মজা করে ঐ গল্প করলেও নায়লা কোনদিনও কারো সঙ্গে এই গল্প করবে না। যদিও প্রায়ই তার মনে হয় জামানকে ঘটনাটা বলে! হয়ত বলবে। এখন না হলেও কোন একদিন। যখন তারা দুজনই বুড়ো হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারা চলে যাবে দূরে দূরে। যখন নায়লার জামান ছাড়া কোন আশ্রয় থাকবে না। জামানেরও নায়লা ছোড়া কেউ থাকবে না–তখন। এই গল্প আপাতত বাক্সবন্দী থাকুক।
সাভার স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাবার গল্পটাও চাপা থাকুক। এমন কিছু না যে আগ বাড়িয়ে বলে বেড়াতে হবে। নায়লার কি জ্বর আসছে? গা জ্বালা করছে–মাথায় শিরা দপদপ করছে . . .। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বাবুর জন্যে কেনা থার্মোমিটার আছে। জ্বরটা দেখলে হয়। ইচ্ছা করছে না।
সামনের সোমবারে বাবুর জন্মদিন। দুবছর হবে। ঠিক দুবছরে তার দুধ ছাড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্রী ঝামেলা করে–বাতিস দুদু, কোলা দুদু। লজ্জায় পড়তে হয়।
আচ্ছা, বাবুর জন্মদিনে ছোটখাট ঘরোয়া ধরনের একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? একটা কেক কেনা হল। বাসায় সে পোলাও-কোরমা রান্না করল। কয়েকজনকে খেতে বলল। তার মা-বাবা, আলম। এই সূঙ্গে অরুণাকেও বলা যেতে পারে। তাহলে জন্মদিনের আসরেই দুজনের দেখা হয়ে যায়। ঝামেলা চুকে যায়। আলমকে অবশ্যি জন্মদিনের কথা বলা যাবে না। বললেই দামী একটা কিছু কিনে নিয়ে এসে সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলবে। অলিমকে বললে–খাবার-দাবার আরেকটু ভাল করতে হবে। বড় মাছের একটা পেট কিনে আনতে পারলে মাছের আইটেম করা যায়। বড় মাছ কি সে পছন্দ করে? ঐ দিন ছোট মাছ খুব আগ্রহ করে খেল। মাকে নিয়ে গিয়ে মেথি দিয়ে গোশত রান্না করালে কেমন হয়? আচ্ছা, সে শুধু আলমের কথা ভাবছে কেন? তার কি অন্য চিন্তা-ভাবনা কিছু নেই?
ঘর কি ময়লা হয়ে আছে। ফিরুর মা নিশ্চয়ই আজ ঘর ঝাঁট দেয়নি। এই মহিলা আছেই শুধু ফাঁকিবাজিতে। বাবুর জন্মদিন উপলক্ষে ফিরুর মাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার। বাবুর জন্যে দরকার হাফহাতা একটা স্যুয়েটার…। লাল রঙের হাফহাতা সুয়েটার বাবুকে খুব মানায়। এ বছর প্রচুর সুয়েটার এসেছে–একদিন সময় করে সুয়েটার দেখে আসতে হবে।
যেদিন তাড়া থাকে
যেদিন তাড়া থাকে সেদিনই একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। আজ জামানের সকাল সকাল অফিসে যাবার কথা। বছর শেষের এই দিনটি জামানদের অফিসের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এইদিন অফিসে কাজকর্ম তেমন কিছু হয় না। কয়েকটা মিটিং হয়। মিটিংএর বিষয়বস্তু হল–বিগত বছরে কোম্পানী কি করেছে তার পর্যালোচনা। সামনের বছরে কোম্পানী কি করবে তার আভাস। পদোন্নতির ব্যাপারগুলিও এই দিনই জানা যায়। দুপুরে কোম্পানীর খরচে লাঞ্চ দেয়া হয়। ফুল রোস্ট, রেজালা, দৈ, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংকস …।
ঠিকমত অফিসে পৌঁছার জন্যে জামান আজ অন্যদিনের চেয়ে আগেই রওনা হয়েছিল। বাসে করে যাচ্ছে–শাহবাগের মোড়ে বাসের ভেতর প্রচণ্ড হৈ চৈ। বাস নাকি বেবীটেক্সির উপর উঠে গেছে। চারদিক থেকে ধর ধর শব্দ। নিমেষের মধ্যে বাসের ড্রাইভার দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়ল। সে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ছুটছে, তার পেছনে ছুটছে রাজ্যের মানুষ। কণ্ডাক্টার পালাতে পারেনি। বাসের যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেছে। শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মার। এই লোকটার দোষ কি? একসিডেন্টের সময় যে যাত্রীদের ভাড়া আদায় করছিল। বেবীটেক্সির উপর বাস তুলে দেয়াতে তার কোন ভূমিকা ছিল না। লোকটাকে কি মেরেই ফেলবে? গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে–এই শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কণ্ডাক্টার বলছে–ঘরে আমার ছোট ছোট দুইটা মাইয়া। আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে–আঁ আঁ আঁ!