জামান শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে?
হুঁ।
ওর ঘুমটা ভাঙাও দেখি।
কেন?
ওর জন্যে একটা খেলনা এনেছি।
কি খেলনা?
জামান কাগজের প্যাকেট খুব সাবধানে খুলছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় চমকে যাবার মত কিছু বেরুবে। যদিও নায়লা খুব করে জানে, সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আজ মাসের ২৩ তারিখ। ওর হাতে কোন টাকাই নেই। সস্তা দামে প্লাস্টিকের বলল কিছু কিনেছে বোধহয়। বাবু অবশ্যি বল পেলেই খুশি। বল কেন যে কোন কিছু হাতে দিলেই খুশি। সেদিন জামান পকেট থেকে চকচকে সাদা রঙের একটা পাথর বের করে বলল, বাবা নাও, পাথর।
নায়লা বলল, পাথর পেলে কোথায়?
জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, মালিবাগ রেল ক্রসিং-এর কাছে রিকশা থেকে নেমে রেল লাইন থেকে নিয়ে এসেছি।
পাথর দিয়ে হবে কি?
বাবু খেলবে।
নায়লা প্রায় বলতে যাচ্ছিল–আমার বাবুর কি এতই খারাপ অবস্থা যে তাকে পথির দিয়ে খেলতে হবে? নিজেকে সামলে নিল–জামানকে এই কথা বলার কোন যুক্তি নেই। সে তার সাধ্যমত করছে। তাছাড়া মজার ব্যাপার হচ্ছে–বাবু ঐ পাথর পেয়ে যত খুশি হয়েছে অন্য কোন খেলনা পেয়ে তত খুশি হয়নি। পাথর সারাক্ষণ তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। সে যখন গোসল করবে তখন পাখরটাকেও গোসল করাতে হবে। তেল মাখাতে হবে। পাথরের মাথার চুল আঁচড়ে দিতে হবে।
জামান প্যাকেটটা প্রায় খুলে ফেলেছে। কালো স্কচ টেপ সরানো হয়েছে। সে রহস্যময় ভঙ্গিতে বাক্স ধরে আছে।
কই লায়লা, বাবুকে তুললে না?
এখন ঘুম ভাঙলে কান্নাকাটি করবে।
যে জিনিস এনেছি দেখলে আর কান্নাকাটি করবে না।
কি এনেছ?
আন্দাজ কর তো দেখি।
মনে হচ্ছে ফুটবল।
ফুটবল বুঝি এ রকম প্যাকেট করে দেয়? বল একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দিয়ে দেয় …, এ অন্য জিনিস দেখলে তোমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে যাবে।
জিনিসটা শেষ পর্যন্ত বেরুল। একটা হেলিকপ্টার। দেখার মতই জিনিস। সুইচ টিপে দিতেই লাল, নীল, সাদা, নানান রকম বাতি জ্বলতে লাগল। সাইরেনের মতো কয়েকবার শব্দ করার পর বন বন করে পাখা উড়তে লাগল। নায়লা হতভম্ব হয়ে বলল, এ কি! এটা কি আকাশে উড়ে যাচ্ছে নাকি?
কথা বলো না। মা দেখ।
হ্যাঁ, আকাশেই তো উড়ছে। উড়ার ভঙ্গি করছে। খট করে দরজা খুলে গেলো—পাইলট বেরিয়ে আসছে নাকি? তাই তো। তাই তো। নায়লা বললো, কী আশ্চর্য! পাইলট বেরিয়ে আসছে?
হুঁ।
জামান হাসছে। এমন ভঙ্গিতে হাসছে যেন এই খেলনা সে নিজেই বানিয়েছে। সে খুব সাবধানে সুইচ বন্ধ করলো।
জিনিসটার দাম কত আন্দাজ কর তো দেখি?
তুমি কিনেছ?
আমি কিনেছি কি না সেটা পরের কথা। দাম আন্দাজ কর।
এক হাজার?
যা বললে তাকে তিন দিয়ে গুন কর।
তিন হাজার টাকা দাম?
চেয়েছিল তিন হাজার। দুহাজার পাঁচশতে দিয়েছে।
তুমি নিশ্চয়ই কেনোনি?
পাগল হয়েছ? আমি কোথেকে কিনব? সে এক ইন্টারেস্টিং ইতিহাস। দাঁড়াও, বলি। গোসল করে নেই। গরম পানি দিয়েছ?
দিয়েছিলাম তো। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধহয়! দাঁড়াও, আবার গরম করি।
লাগবে না, লাগবে না। তুমি টেবিলে ভাত দিয়ে দাও। খিদে মারাত্মক লেগেছে। নায়লা, খেলনাটা খুব সাবধানে টেবিলের উপর তুলে রাখ! ব্যাটারিটা খুলে রাখ। থাক, দরকার নেই–তুমি খুলতে পারবে না।
জামান বাথরুমে ঢুকে গেছে। বাবু উঠে পড়েছে। সে বিছানায় বসে চেঁচাচ্ছে–মাম্মাট। মাম্মাট।
ছোট বাচ্চারা মাকে মাই ডাকে। মা ডাকটাই সহজ। কিন্তু বাবু ডাকে মাম্মটি। দুই বছরের বাচ্চা এমন কঠিন শব্দ কি ভাবে বলে কে জানে? এরকম কঠিন শব্দ শিখলই বা কার কাছে?
আম্মাট। মাম্মাট?
আসছি বাবা। আসছি।
বাতিস দুদু দাও।
বাতিস দুদু হচ্ছে তাকে বালিশে শুইয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সে তিন রকম দুধ খেতে চায়–কোল দুদু (কোলে করে খাওয়াতে হবে), বসা দুদু (নায়লা বসে থাকবে, সে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে) এবং বাতিস দুদু।
নায়লা বাতিস দুদু খাওয়াচ্ছে। জামান গোসল করার মাঝখানে সাবান গায়েই বাথরুমের দরজা খুলে মুখ বের করলো, বাবু উঠে গেছে না কি?
হুঁ। বাতিস দুদু খাচ্ছে।
ওকে ঘুম পাড়িও না। জাগিয়ে রাখবে।
ও জাগবে না। বাতিস দুদু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে।
কথা বলে বলে জাগিয়ে রাখ।
কথা বলে জাগাবে কি, বাবু এর মধ্যেই ঘুমিয়ে কাদা। দুধ খাচ্ছে এই সঙ্গে অভ্যাসমত মায়লার মাথার চুল ধরে আছে।
নায়লা!
হুঁ।
হেলিকপ্টারের শানে নজুলটা শোন …
গোসল শেষ করে এসো, তারপর শুনব। বেশিক্ষণ পানি লাগাবে না ঠাণ্ডা লাগবে।
জামান গোসলের শেষে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। আজ আর সে অন্যদিনের মত গোসল শেষ করে বিছানায় শুয়ে থাকলো না–সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসলো।
বুঝলে নায়লা, দুপুরে লাঞ্চকে হয়েছে। আমার বস বদরুল সাহেব খবর পাঠালেন–আমার টেলিফোন। উনি খুবই বিরক্ত। উনার টেবিলে কেউ টেলিফোন করলেই উনি বিরক্ত হন। উনার ধারণা, এটা উনার পার্সোনাল টেলিফোন—অফিসের না। যাই হোক, টেলিফোন ধরলাম। দেখি একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। খুব মিষ্টি গলা।
নায়লা বলল, মেয়েটা কে?
বলছি তো–অস্থির হয়ো না। অস্থির হবার কিছু নেই। মেয়েটা হল হোটল শেরাটনের রিসিপশনিস্ট। এস, আলম নামের এক লোক আমাকে খোঁজ করছেন। রুম নম্বর দিয়ে রেখেছেন, আমি যেন সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি। আমি ধাধার মধ্যে পড়ে গেলাম–এস. আলমটা কে? একবার ভাবলাম যাব না, তারপর মনে করলাম, দেখেই আসি। গিয়ে দেখি আমাদের বল।