নায়লা।
জি।
তুমি এমন গাল-টাল লাল করে বসে আছি, ব্যাপার কি? তুমি কি আগে কখনো কোন ছেলের সঙ্গে বসে চা খাওনি?
নায়লা জবাব দিল না।
বিয়ের আগে প্রেম-টেম কিছুই হয়নি?
আলম ভাই, আজ আমি উঠি। বাবুর শরীরটা ভাল না, কাশি?
বাবু তো জঙ্গলে পড়ে নেই। বাবার সঙ্গে আছে। ভাক্তার তাকে দেখবেন। ইতিমধ্যে হয়ত ওষুধও দেয়া হয়েছে। আমার সঙ্গে বসে থাকতে কি তোমার অস্বস্তি লাগছে?
অস্বস্তি লাগবে কেন?
সেটাই তো কথা–অস্বস্তি কেন লাগবে? শোন নায়লা, আমি যে ক্রমাগত বক বক করে যাচ্ছি তার একটা কারণ আছে। আমি আমেরিকার যে অঞ্চলে বাস করি সেখানে বাঙালীর বংশও নেই। মাসের পর মাস চলে যায় কোন বাংলা কথা শুনি না।
বাংলা কথা শুনবার জন্যে আপনি আমাকে বসিয়ে রেখেছেন?
না। তোমার সঙ্গ পাবার জন্যে বসিয়ে রেখেছি। এই সময়ের তরুণী মেয়েরা কি ভাবে কথা বলে, কি ভাবে, এই সব আমার জানা দরকার। দুদিন পর একজনের সঙ্গে বাস করতে যাচ্ছি। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি।
কি শিখছেন?
প্রথম যা শিখলাম তা হচ্ছে–এ দেশের বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্য কোন যুবকের সঙ্গে সহজ হতে পারে না। তারা সহজ হয় স্বামীর উপস্থিতিতে। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। শোন নায়লা, বেলা বারোটা পর্যন্ত তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।
কেন?
কারণ বারোটা পর্যন্ত আমি একটা গাড়ি ভাড়া করেছি–আমার ধারণা ছিল অরুণা নামের তোমার ঐ বান্ধবীর বাসায় যাওয়া—গল্প করা—তারপর তোমাকে নামিয়ে দেয়াতে বারোটার মত বেজে যাবে। যেহেতু অরুণা-প্রোগ্রাম বালি সেহেতু তোমাকেই থাকতে হবে বারোটা পর্যন্ত। আমি তো শুধু শুধু টাকা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
এত কিছু বলার দরকার নেই। আমি থাকব বারোটা পর্যন্ত।
গুড। তাহলে চল একটা ঘোড়া কিনে নিয়ে আসি।
কি কিনবেন?
ঘোড়া–The Horse.
সত্যি ঘোড়া কিনবেন?
অবশ্যই কিনব। সাভারে পাওয়া যায়। তুমি বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
নায়লা ক্ষীণ গলায় বলল, আমি বিশ্বাস করছি।
বিশ্বাস করছ কেন?
বিশ্বাস করছি, কারণ আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবেন কেন?
ঠিক ধরেছ। আমি মোটেই মিথ্যা বলছি না। আমি দেখে এসেছি সাভারে ঘোড়া বিক্রি হয়। তাই একটা কিনব।
চলুন যাই।
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে মাটির খেলনার দোকান থেকে আলম বিশাল আকৃতির মাটির মোড় কিনল। শুধু ঘোড়া না–ঘোড়া এবং হাতী দুটাই কিনল। হাসিমুখে বলল, তোমার ছেলের জন্যে কিনলাম। ঘোড়া এরা সুন্দর বানিয়েছে। কিন্তু হাতি সুবিধা হয়নি। দেখতে ইঁদুরের মতে লাগছে। তাই না? মনে হচ্ছে না বড় সাইজের ইঁদুর?
হুঁ।
তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন নায়লা? মনে হচ্ছে তোমার আশাভঙ্গ হয়েছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমি সত্যি সত্যি ঘোড়া কিনব?
হ্যাঁ। টাকাওয়ালা মানুষদের কত অদ্ভুত শখ থাকে। আমরা তাদের সেইসব শখ দেখে মজা পাই?
ভুল কথা বললে নায়লা। টাকাওয়ালা মানুষদের অদ্ভুত শখ থাকে না। আসলে তাদের কোন শখই থাকে না। শখ থাকলেই টাকা খরচ। টাকা খরচ হলে এর টাকাওয়ালা হবে কিভাবে? চল যাওয়া যাক।
নায়লা বলল, স্মৃতিসৌধটা দেখে যাই। আমি আগে কখনো দেখিনি।
তোমার দেরি হয়ে যাবে না?
হবে। একবার যখন দেরি হয়ে গেছে, হোক।
গুড। এই হল স্পিরিট।
নায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জায়গাটা এত সুন্দর, ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলতাম।
ক্যামেরা আমার ব্যাগে আছে। ছবি তুলতে চাইলে তুলে দেব।
না থাক, লাগবে না।
কেন লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। তুমি এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক, আমি ক্যামেরা নিয়ে আসছি।
নায়লা দাঁড়িয়ে আছে। আলম ক্যামেরা আনতে যাচ্ছে। গাড়ি অনেক দূরে। আলমকে অনেকখানি জায়গা হাঁটতে হবে। নায়লার কেন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। অস্থিরতাটা কি অন্যে? বাবুকে বেখে এসেছে, সে অন্যে? নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে? জামান বাবুকে ডাক্তার দেখিয়ে মার কাছে রেখে অফিসে যাবে। এই ছিল কথা। রেখে এসেছে নিশ্চয়। আচ্ছা, বাবু কি কিছু খেয়েছে? মার বাসায় বাবুকে দিয়ে আসার এই এক সমস্যা। এরা নিয়ে শুধু খেলবে–খাওয়ার সময় খাওয়াবে না। তাছাড়া বাবুর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে পিপি আটকে রাখা। কিছুতেই করবে না। বাথরুমে নিয়ে শিষ দিয়ে দিয়ে পিপি করাতে হয়।
নায়লা, দেখি তাকাও তো?
নায়লা তাকাতেই আলম ছবি তুলল। হাসতে হাসতে বলল, আমি ড্রাইভারকেও নিয়ে এসেছি। সে আমাদের ছবি তুলে দেবে।
আমাদের ছবি তুলে দেবে মানে কি? নায়লা কি চেয়েছে আলমের সঙ্গে ছবি তুলতে? এখন সে কি বলবে? সে কি বলবে, আপনার সঙ্গে ছবি তুলব না। এটা বলা যায় না। অভদ্রত হয়। আলম চাইলে–ছবি তুলতে হবে। আলম দীর্ঘদিন বাইরে আছে–তার কাছে এই ব্যাপারগুলি হয়ত খুব স্বাভাবিক। এ দেশের জন্য না। এ দেশে স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে ছবি তোলা যায় না।
নায়লা, আমার পাশে দাঁড়াও।
নায়লা দাঁড়াল।
হাসিমুখে দাঁড়াও। তুমি এমন মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছ যে মনে হচ্ছে–ফাঁসির হুকুম হয়েছে। ছবি তোলার পর পরই তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। মুখ এমন কালো কেন?
নায়লা ক্ষীণ স্বরে বলল, দুঃশ্চিন্তা লাগছে। বাবুকে রেখে এসেছি।
বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে বিদেশী মেয়েদের এই একটা বড় তফাৎ। বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে বাঙালী তরুণী আর তরুণী থাকে না–মা হয়ে যায়। বিদেশীনীদের ব্যাপারটা কেমন জান? বাচ্চা যখন পাশে থাকবে তখন মা, যখন পাশে থাকবে না তখন লাস্যময়ী তরুণী। নায়লা শোন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি—আমার ধারণা, বাচ্চাকে বাসায় রেখে তুমি কখনো জামানকে নিয়ে ঘুরতে বের হও না। না-কি হও?