কফি শপটা সুন্দর। লোকজন একেবারেই নেই। সকাল দশটার দিকে এ দেশের লোকজন কফি খেতে চায় না। এরা কফি খায় বিকেলে। আলম বলল, নায়লা, এখন তুমি তোমার বান্ধবী সম্পর্কে আমাকে ব্রীফিং দাও–তার নাম হল–অরুণা, তাই না?
হুঁ।
পড়াশোনা কতদূর?
বিএ পাশ করার পর বিএড ডিগ্রী নিয়েছে–এক সময় স্কুলে পড়াত। এখন রিসিপশনিস্টের কাজ করছে।
সর্বনাশ! মাস্টারনী?
মাস্টারনীতে অসুবিধা কি?
মাস্টাররা পৃথিবীর সবাইকে ছাত্র মনে করে–এই হচ্ছে অসুবিধা। বাসররাতে জিজ্ঞেস করে বসতে পারে–বাসররাত কোন সমাস?
নায়লা হাসছে। শব্দ করে হাসছে। গালে কী সুন্দর টোল পড়েছে! আলম বলল, তোমার নিজের পড়াশোনা কি? নায়লা হাসি থামিয়ে বলল, আমার পড়াশোনা নেই।
স্বরে অ, স্বরে আ জান? না তাও জান না?
না জানার মতই। আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারিনি। পরীক্ষার একমাস আগে বিয়ে হল–পরীক্ষা দেয়া হল না। পরের বছর পরীক্ষা দেব ভেবেছিলাম–সেই বছর বাবু হল, এখন উৎসাহ চলে গেছে।
বিয়ের জন্যে পড়াশোনা দরকার ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে, আর পড়াশোনা দিয়ে কি হবে, তাই না?
নায়লা জবাব দিল না। আলম বলল, তোমার মন খারাপ করিয়ে দিলাম কি?
উঁহু।
চল যাওয়া যাক। মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি সত্যি কথাই বলছি। এখন পর্যন্ত মেয়েদের সবকিছু বিয়ে এবং বিয়ের পরে স্বামী নামক বস্তুটি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। জামানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে তুমি একরকম হয়েছ জামানের সঙ্গে বিয়ে না হয়ে আমার সঙ্গে হলে তুমি হতে অন্যরকম। আমি বা জামান–আমরা বদলাচ্ছি না। বদলাচ্ছ তুমি। মেয়েরা পুরোপুরি পানির মত। নিজের আকৃতি নেই–যে পাত্রে রাখা হচ্ছে সেই পাত্রের আকার ধারণ করছে।
সবাই করচ্ছে না। কেউ কেউ হয়ত করছে।
আলম বলল, করছে না এমন সংখ্যা খুবই অল্প। যারা করছে না–তাদের আবার বিয়ে হচ্ছে না–হলেও বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বিয়ে টিকছে না। বিয়ে যাতে না ভাঙে, এই জন্যেই মেয়েরা নিজেদের বদলায়। বদলানোর ব্যাপারটা পুরুষদের জন্যে কঠিন বলেই মেয়েরাই এই কাজটা করে। তারা যে জেনেশুনে করে তাও কিন্তু না। প্রকৃতি তাদের ডিএনএ অণুতে এই ব্যাপারটি লিখে দিয়েছে। প্রোগ্রাম করা। কেন এ রকম প্রোগ্রাম করা সেটা জান?
না।
জানতে চাও? বলব?
অন্য সময় বলবেন। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। অরুণাকে পাব না।
না পেলে না পাব। কথাগুলি জরুরী, তুমি শুনে রাখ। তোমার লাভ হবে।
কি লাভ?
নিজেকে জানতে পারবে। নিজেকে যত ভাল জানবে ততই লাভ। নিজেকে জানতে চাও না?
নায়লা কিছু বলল না। আলম বলল, এসো আরেক কাপ কফি খাওয়া যাক। কফি খেতে খেতে ব্যাপারটা তোমার কাছে ব্যাখ্যা করি।
আমি আর কফি খাব না, আপনি খান।
তুমি তাহলে চা খাও–দিতে বলি?
বলুন।
আলম চায়ের কথা বলে নায়লার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এল। তার চোখ চকচক করছে। আগ্রহী শ্রোতাকে কথা শোনানোর আনন্দের সবটাই এখন তার চোখে মুখে।
প্রকৃতি যে এই কাজটা করে, কেন করে? প্রকৃতি অকারণে কিছু করে না। তার সবকিছুর পেছনে কারণ আছে। যুক্তি আছে। বর্তমান নিয়ে প্রকৃতির তেমন মাথাব্যথা নেই। প্রকৃতির দৃষ্টি সব সময় ভবিষ্যতের দিকে। প্রকৃতি দেখে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি। সে সেই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যেই এই কাজটা করে। বুঝতে পারছ?
না।
তোমার এবং তোমার স্বামীর সুসম্পর্কের উপর নির্ভর করছে তোমার ছেলেমেদের ভবিষ্যৎ। প্রকৃতি সেই দিকে লক্ষ্য রেখে চেষ্টা চালাবে সম্পর্ক ঠিক রাখতে। স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি যে ভাবলাসী ও মমতা তৈরি হয় তার অনেকটাই মিখা ভালবাসা, মিথ্যা মমতা। এই মিথ্যা প্রকৃতির সৃষ্টি।
কি যে আপনি বলেন।
শুনতে খারাপ লাগলেও যা বলছি তা সত্যি। তুমি জামানকে ভালবাস, বাস না?
এই প্রসঙ্গ খাক।
থাকবে কেন, এসো আমরা এনালাইজ করি। ধরে নেয়া যেতে পারে, এই ভালবাসা তীব্র। জামান অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে তুমি অস্থির হও। ফেরার সময় গেটের দিকে তাকিয়ে থাক। যেই দেখ সে রিকশা থেকে নামছে তুমি আনন্দে অভিভূত হও …।
আপনি বলতে চাচ্ছেন এই আনন্দের মধ্যে ভালবাসা নেই?
থাকলেও খুব সামান্য। এই আনন্দের প্রায় সবটাই নিরাপত্তাবোধের আনন্দ। তুমি একজনকে দেখছ যে তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে, তোমাকে আশ্রয় দেবে, তোমার শারীরিক চাহিদা মেটাবে।
আপনি বলতে চাচ্ছেন–আমাদের যে সব চাহিদা আছে সেই সব বাইরে থেকে মেটাবার ব্যবস্থা থাকলে আপনার বন্ধুর জন্যে আমার ভালবাসা থাকবে না?
না থাকারই কথা। তোমাদের দুজনের চরিত্র সম্পূর্ণ দুরকম।
সম্পূর্ণ দুধরনের চরিত্রের দুটি মানুষ একজন আরেকজনকে ভালবাসতে পারে না?
ভালবাসা ব্যাপারটাই ধোঁয়াটে। প্রকৃতির এক খেলা, যার উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ মানব সৃষ্টির নিরাপত্তা…
আপনার এই বক্তৃতা বন্ধ করুন। শুনতে ভাল লাগছে না।
চল রওনা দেয়া যাক।
আজ গিয়ে লাভ হবে না–অরুনা স্কুলে চলে গেছে।
জামান খুশি খুশি গলায় বলল, আজ না যাওয়াই ভাল। তাছাড়া তোমার সঙ্গে যেতেও চাচ্ছি না। এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে আরেক তরুণীকে দেখতে যাওয়ার কোন মানে হয় না। আমি জামানকে নিয়ে কাল-পরশু যাব।
আমি চলে যাই তাহলে?
এত তাড়া কিসের? বস।
বসে কি করব?
গল্প করবে। তুমি গল্প করতে না চাইলে আমি গল্প করব, তুমি শুনবে।
নায়লার অস্বস্তি লাগছে। সে গল্প করবে? কি গল্প করবে?