টেলিফোনের কথা শেষ হওয়া মাত্র আবার তাঁর স্মৃতি ফিরে এল–তিনি জামানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কোথায় সই করতে হবে? সব দেখে দিয়েছেন তো?
জি স্যার?
গুড। প্রয়োজনে একবারের জায়গায় দশবার দেখবেন কিন্তু ভুল যেন না থাকে।
জামান ফাইল হাতে নিজের ঘরে এসে দেখে নায়লা তার সামনের চেয়ারে বসে আছে। নায়লার মুখ হাসি হাসি। কাজেই কোন দুঃসংবাদ দিতে আসেনি। সাহেবদের স্ত্রীরা অফিসে গল্প-গুজব করতে আসেন। তার মতো মানুষের স্ত্রীরা অফিসে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে।
কি ব্যাপার লায়লা?
তোমার ভাত নিয়ে এসেছি।
কোন দরকার ছিল না তো। ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম।
লায়লা হাসল। জামানকে অবাক করে দিতে পেরেছে এতেই সে আনন্দিত। আজ সকালে সে জামানের ভাত রাধতে পারেনি। এমন ঝামেলা বেঁধে গেল! একদিকে বাবু কাঁদে, অন্যদিকে ফিরুর মার চিৎকার–সে কাজ করবে না। তাকে বেতন দিয়ে বিদায় দিতে হবে।
এই মহা ঝামেলার ভেতর ভাত হবে কি ভাবে? জামান বলেছে, তুমি ব্যস্ত হয়ে না, আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। নায়লা বলেছে, আচ্ছা। কিন্তু তখনি সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, ভাত বেঁধে সে টিফিন কেরিয়ারে করে অফিসে নিয়ে আসবে।
জামান বলল, বাবু কোথায়? ওকে কার কাছে রেখে এসেছ? ফিরুর মার কাছে?
পাগল! ওর কাছে আমি বাবুকে রেখে আব? মার কাছে রেখে এসেছি।
কলাবাগানে গিয়েছিলে?
হুঁ।
এত ঝামেলা করার কোন দরকার ছিল না।
একটু না হয় করলামই ঝামেলা। রোজ রোজ তো করি না। এখন বল ভাতটা খাবে কোথায়, এখানে?
না, ক্যান্টিনে।
তাহলে চল ক্যান্টিনে যাই।
তুমি বাসায় চলে যাও, আমি খেয়ে নেব।
নায়লা হাসিমুখে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গেলে কি কোন অসুবিধা আছে? নাকি তোমাদের ক্যান্টিনে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ?
নিষেধ না, চল।
প্লেট-গ্লাস এগুলি কি ক্যান্টিন থেকে নেবে?
হুঁ।
তাহলে দুটা প্লেট নিও তো। আমিও তোমার সঙ্গে খাব। দুজনের খাবার এনেছি।
জামান খানিকটা ব্রিত ভঙ্গিতেই স্ত্রীকে নিয়ে কোণীর দিকে একটা টেবিলে বসেছে। তাদের ক্যান্টিনে দুজন মাত্র মহিলা কাজ করেন, তারা কখনো ক্যান্টিনে খেতে আসেন না। কাজেই এই ক্যান্টিন মহিলা বর্জিত। ক্যান্টিনের বয়-বাবুর্চি সবাই কৌতূহলী চোখে দেখছে।
নায়লা বলল, মার বাসায় আজ খাসির গোশত রান্না হয়েছে। তোমার কাছে আসছি শুনে মা গোশত দিয়ে দিয়েছেন। আমি এনেছি শুধু বেগুন ভাজা আর ডাল। এদেরকে বলেলে কি এরা কাঁচামরিচ দেবে? আমি কাঁচামরিচ আনতে ভুলে গেছি।
জামান কাঁচামরিচ দিতে বলল।
নায়লা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায়ই দুপুরে এই ক্যান্টিনে এসে সে খেয়ে যায়। নায়লা বলল, তুমি নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছ, ব্যাপার কি? কথা বল।
কি কথা বলব?
যা ইচ্ছা বল।
অফিসে তুমি কথাবার্তা বল না? আচ্ছা, আজ অফিসে সবচে মজার ঘটনা কি ঘটেছে?
অফিসে মজার ঘটনা কিছু ঘটে না।
নায়লা বলল, আজ তো একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, সেটাই না হয় বল।
জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কই, আজ তো কিছু ঘটে নি।
ঘটবে না কেন? এই যে আমি এসেছি এটা একটা মজার ঘটনা না?
নায়লা হাসছে। হাসলে তার বাম গালে টোল পড়ে। দেখতে জামানের বেশ মজা লাগে। ভরাট গালের মেয়ে, হঠাৎ সেখানে একটা গর্ত হয়ে গেল।
নায়লা বলল, অবাক হয়ে কি দেখছ?
কিছু না।
অবশ্যই কিছু দেখছ। বল না কি?
কিছু দেখছি না নায়লা।
তুমি আরাম করে খচ্ছি না। বার বার শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ। আরাম করে খাও তো। তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে বসে খাচ্ছ, এটা কোন গুরুতর অপরাধ না যে এমন সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে। খাসির গোশতটা খেতে কেমন হয়েছে?
ভাল।
মেথি দিয়ে রান্না। এই রান্নাটা আমি জানি না। কতবার ভেবেছি শিখে নেব, আর শেখা হয় না। তোমার বন্ধুকে দাওয়াত করে একদিন মার হাতের মেথি দিয়ে রান্না করা গোশত খাওয়াব। তাহলে সে বুঝবে রান্না কাকে বলে।
আচ্ছা।
তোমার বন্ধু ভাল খাবার খুব পছন্দ করে, তাই না।
হুঁ।
এরকম লোককে খাইয়ে অনিন্দ আছে। তোমাকে খাইয়ে কোন আনন্দ নেই। তোমার কাছে মনে হয় সব খাবারই এক রকম লাগে, তাই না?
জামান হাসল।
সঙ্গে সঙ্গে নায়লাও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমি কিন্তু পান খাব। তোমাদের এখানে পান পাওয়া যায়?
যায়।
তাহলে আনতে বল। মিষ্টিপান খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুক্ষণ এখানে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করব। এই অপরাধে তোমার বড় সাহেব আবার তোমার চাকরি নট করে দেবে না তো?।
জামান কিছু না বলে নিজেই পান আনতে গেল। মিষ্টিপান এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাশে একটা দোকানে ভাল মিষ্টিপান করে।
দুটা পান এক সঙ্গে মুখে দিয়ে নায়লা বলল, ঐ মেয়েটা কি পান খেত?
জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কোন মেয়ে?
যে মেয়েটার প্রেমে তোমার বন্ধু হাবুডুবু খাচ্ছিল।
ও আচ্ছা, রেশমার কথা বলছ?
ওর নাম রেশমা?
হুঁ।
রেশমা কি পান খেত?
জানি না তো। এত লক্ষ্য করিনি।
মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?
সুন্দর ছিল।
সুন্দর মানে কি রকম সুন্দর? খুব সুন্দর?
হ্যাঁ, খুব সুন্দর। মেয়েটা দেখতে অনেকটা তোমার মতই ছিল।
সত্যি?
হুঁ।
নায়লা আগ্রহের সঙ্গে বলল, ওর কোন জিনিসটা আমার মত ছিল, চোখ, চুল, নাক, মুখ–কোনটা?
আমি বলতে পারব না। আলমকে জিজ্ঞেস করো। ও বলতে পারবে।
ঐ মেয়ের গালেও কি টোল পড় তো?
হুঁ।
এটা দেখি আবার মনে আছে।
আলম সব সময় বলতে, এই জন্যে মনে আছে।