বাবু ঘ্যান ঘ্যান করছেই—মাম্মাট কোলা দুদু। মাম্মাট কোলা দুদু।
আলম বলল, মাম্মাট কোলা দুদু বাক্যটার মানে কি?
নায়লা বলল, ওর ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পেলে এরকম বলে।
আলম বলল, জামান, তুই ওকে কোলে নিয়ে বারান্দা বরাবর খানিকটা হাঁটাহাঁটি কর। ও ঘুমিয়ে পড়ুক। সামান্য একটা গাড়ি আনতে এত দেরি করছে কেন কে জানে।
জামান ছেলেকে নিয়ে হোটেলের লবীর শেষ মাথায় চলে গেল। আলম এবং নায়লা শুধু দাড়িয়ে। আমি তাকিয়ে আছে নায়লার দিকে। হঠাৎ নায়লার কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল। তার মনে হচ্ছে–কিছু একটা হয়েছে। চারপাশের পরিবেশ পাল্টে গেছে বা অন্য কিছু। এ রকম মনে হবার কারণ কি? নায়লার বুক ধরফড় করছে। পিপাসা বোধ হচ্ছে।
আলম সিগারেট ধরাল। লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, নায়লা। তুমি আমার দিকে তাকাও তো।
নায়লা তাকাল।
আলম বলল, একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা তোমাকে বলা দরকার।
কি সমস্যা?
সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল ছিল। কিছু কিছু সমস্যা আছে যা নিয়ে আলোচনা করতে নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে …
সমস্যাটা কি বলুন।
তুমি কিছু ধরতে পারছ না?
না।
আমার মনে হয় তুমি ধরতে পারছ। তুমি কোন বোকা মেয়ে নও। বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার ধারণা অসম্ভব বুদ্ধিমতী।
আমার সম্পর্কে আপনি ভুল ধারণা করেছেন। আমি মোটেই বুদ্ধিমতী না?
আলম আধ-খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে দু হাত প্যান্টে ঘসতে ঘসতে স্পষ্ট গলায় বলল, কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে আমি প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে তাকে যখন প্রায় ভুলেছি তখন তোমার সূঙ্গে দেখা। জামান কি কখনো তোমাকে বলেছে যে তুমি দেখতে হুবহু সেই মেয়েটির মত? হাসলে ঐ মেয়েটির বা গাকে টোল পড়ত। তোমারও পড়ে। এই যে তুমি আমার জন্যে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছি, এটা অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার নিয়তি কি জান? আমার নিয়তি হচ্ছে এক একবার প্রেমে পড়ব। কিন্তু প্রেমিকাকে কাছে পাব না। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভুল হয়েছে। আমি আমি … আচ্ছা বাদ দাও।
আলম আরেকটা সিগারেট ধরে কাশতে লাগল। গাড়ি চলে এসেছে। ছোট গাড়ি পায়নি, বার সীটের মাইক্রোবাস। আলম এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা কলল। জামান ছেলেকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। আলম বলল, ড্রাইভারকে বলেছি তোদের নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরে তারপর বাসায় যাবে। আর শোন, ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছি। যা, গড়িতে ওঠ।
জামান বলল, তুইও আয় আমাদের সঙ্গে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবি।
না।
নায়লা যন্ত্রের মত গাড়িতে উঠেছে। জানালার পাশে বসেছে। তার চোখ গাড়ির মেঝেতে নিবদ্ধ। সে একারও চোখ তুলে কোন দিকে তাকাচ্ছে না। বাইরে শীতল হাওয়া কিন্তু তার গরম লাগছে। খুব পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বরফের কুচি মেশানো ঠাণ্ডা পানি।
ঘুমন্ত বাবুকে কোলে নিয়ে জামাল সিড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। নায়লা বলল, লিফটে উঠ। এক-আধবার লিফটে উঠলে কিছু যায় আসে না।
জামান বলল, না না, ঠিক হবে না। তুমি ওঠ। লিফটে ওঠ। আমি সিঁড়ি দিয়ে থেমে থেমে ওঠব। অসুবিধা হবে না।
জামান সিঁড়ি ভেঙে ওঠছে। নায়লা লিফটের বোতাম টিপে লিফটের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবুকে জামানের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কেন সে নেয়নি? সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তার ঘুম পাচ্ছে, প্রচণ্ড ঘুম। মনে হচ্ছে সে লিফটে উঠেই ঘুমিয়ে পড়বে।
তার ঘুমুতে গেল রাত এগারোটার দিকে। নায়লা বাইরের কাপড় বদলায়নি। নতুন শাড়ি পরেই হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। মশারিও খাটানো হয়নি। সে ক্লান্ত গলায় বলল, মশারি খাঁটিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেবে?
তুমি কাপড় বদলাবে না?
না।
জামান মশারি খাটাল। বাবুকে ঘুমের মধ্যেই বাথরুম করিয়ে আনল। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে এলো। খাটের দু প্রান্তে দুঞ্জন, মাঝখানে বাবু।
খুব প্রচণ্ড ধুমের কিছু সমস্যা আছে। প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম কেটে যায়। তখন আর ঘুম আসতে চায় না। নায়লার কি তাই হয়েছে? জামান বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম কেটে গেছে। মাথায় চাপা যন্ত্রণা নিয়ে সে শুয়ে আছে। এই যন্ত্রণা দূর হবার নয়। ঠাণ্ডা করে নিচে মাখা দিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হয়ত মাথার যন্ত্রণাটা কমত।
নায়লা বিছানায় উঠে বসল। ঘুম আসবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আর শুয়ে থাকা যায় না। জামান, বাবু দুজনেই ঘুমুচ্ছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যাচ্ছে না–কিন্তু তারা যে আরাম করে নিঃশ্বাস ফেলছে এই শব্দ কানে আসছে …।
নায়লা অন্ধকারে পা টিপে দরজা খুলে ছাদে চলে এল।
জামান বড় সাহেবের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছিল
জামান বড় সাহেবের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছিল। এক মিনিটে কাজ হয়ে যাবার কথা–দুটা সই দেবেন। সে ফাইল নিয়ে চলে আসবে। সে জায়গায় সময় লাগল এক ঘন্টা দশ মিনিট। বড় সাহেবের টেলিফোন চলে এল। তিনি একটা সিগনেচার দিয়ে টেলিফোন ধরলেন এবং কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা কথা বললেন।
এই এক ঘণ্টা জামানকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কারণ কেরানি শ্রেণীর কেউ বড় সাহেবের ঘরে চেয়ারে বসবে না। এটাই অলিখিত নিয়ম। জামানকে ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হল, বড় সাহেব বসার জন্যে ইশারা করলেন না। ঘরে যে একজন মানুষ ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্যাপারটা তিনি যেন পুরোপুরি ভুলে গেলেন। স্মৃতিভ্রষ্ট হলেন।