আলম হাসতে হাসতে বলল, নায়লা, এমন হা করে তাকিয়ে থেকো না।
আমাদের দেখার জন্যেই তো এই মেয়ে এমন কাপড় পড়েছে। দেখতে অসুবিধা কি।
অসুবিধা নেই, দেখো। নায়লা, তোমার যুক্তি সুন্দর। কথার পিঠে চট করে যুক্তি দেয়া সহজ ব্যাপার না।
নায়লা লজ্জা পেল। টেবিলটার দিকে এখন আর তাকানো যাবে না, কিন্তু নায়লার খুব ইচ্ছা মেয়েটার কাণ্ডকারখানা দেখে! এই মেয়ে কি পারবে এই পোশাকে হোটেলের বাইরে যেতে? মনে হয় না। ঢাকার রাস্তায় বের হলে তার চারদিকে ভিড় জমে যাবে।
বেয়ারারা খাবার আনতে শুরু করেছে। এত খাবার! কে খাবে এত খাবার? কত টাকা বিল হবে একবেলা খাবারের জন্যে? ন্যাপকিনের দু পাশে ঝকঝক করছে চামচ। চামচগুলি কি রূপার? দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে।
আলম বলল, ভাবী, তুমি চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছ কেন? খাওয়া শুরু কর।
নায়লা চমকে উঠল। ভাবী বলে ডাকার জন্যেই চুমকাল। এতক্ষণ নায়লা নায়লা করছিল, হঠাৎ ভাবী। সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল নায়লা ডাকেই। মানুষ কত সহজেই না অভ্যস্ত হয়।
ভাবী, আমার বিয়ের জন্যে কন্যা দেখতে শুরু করেছ?
এতক্ষণ তে নায়লা নায়লী ডাকছিলেন হঠাৎ ভাবী ডাকা শুরু করলেন কেন?
ভাবী সম্পর্কটা আমি ভুলে যাইনি। এটা বোঝাবার জন্যেই ভাবী ডাকা। মাঝে মধ্যে ডাকব। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব এখনো জবাব দাও নি–মেয়ে দেখেছ?
হুঁ, একজন দেখেছি।
নাম কি?
অরুনা।
নাম মন্দ না। দেখতে কেমন?
খুব সুন্দর।
গায়ের রঙ?
ধবধবে শাদা রঙ।
চোখের মনির রঙ কি কালো না কটা?
এত খুঁটিয়ে তো দেখিনি।
উচ্চতা?
লম্বায় আমার মতই।
ওজন? কোমরের মাপ?
নায়লা তাকিয়ে আছে। আলম বলল, শোন নায়লা, তুমি যা করবে তা হচ্ছে–একটা গজফিতা নিয়ে ঐ মেয়ের কাছে যাবে। হাইট মাপবে, কোমর মাপবে . . . ওজনটা জানবে। পার্সোনাল হেবিটস নোট করবে। অসুখ-বিসুখ কি আছে তাও জানা দরকার। যে ডাক্তারের কাছে এই মেয়ে সচরাচর যায় তাকে জিজ্ঞেস করবে …
আচ্ছা আপনি পাগলের মত এইসব কি বলছেন?
মোটেই পাগলের মত কিছু বলছি না। প্রাকটিক্যাল মানুষের মত কথা বলছি। টরেন্টোতে একটা ছেলে ছিল–বসিরুল হক নাম। দেশ থেকে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এল। ডানাকাটা পরী বলতে যা বোঝায়, তাই। মনে হয় সদ্য ডানা কাটা হয়েছে। কাটার দাগ এখনো মিলায়নি। রূপের কম্পিটিশনে এই মেয়ে হয় মিস বাংলাদেশ হবে কিংবা রানার্স আপ হবে। যাই হোক, রূপবতীকে বিয়ে করে বসিরুল হক যে বিপদে পড়ল তার কোন তুলনা নেই। হেন রোগ নেই যা এই মেয়ের নেই। হাঁপানি আছে, বুক ধড়ফড় আছে, হিস্টিরিয়া আছে, ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আছে। সামান্য ডায়াবেটিসও আছে। কিছু দিন আগে শুনলাম হার্টের সমস্যাও ধরা পড়েছে–ড্রপ বিট হয়, ..
নায়লা শব্দ করে হেসে উঠল। আশেপাশের টেবিলের সবাই তাকাচ্ছে। নায়লা হাসি থামাতে পারছে না।
বাবুও মার সঙ্গে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে–বলল, মাম্মাট বাকরু।
বাকুরু হচ্ছে ভয়াবহ ধরনের সিগন্যাল। বাকরু মানে সে বাথরুমে যাবে এবং কড় কাজটি করবে।
নায়লা হাসি থামিয়ে শুকনো মুখে জামানের দিকে তাকাল। জামান বিড় বিড় করে বলল, সমস্যা হয়ে গেলো তো।
অলিম বলল, সমস্যা কি, বাবু বাথরুম করবে?
বাথরুম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা সমস্যা। বাথরুম করতে চাওয়াটা সমস্যা না। জামান, তুই যা, ছেলেকে বাথরুম করিয়ে আন।
নায়লা বলল, ও পারবে না। আমি যাচ্ছি।
উঁহু, বাইরে এসে মায়েরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হবে না। নিয়ম নেই–আমি যাচ্ছি।
না না, আপনি পারবেন না।
অবশ্যই পারব। একটা শিশুকে বাথরুম করানো এমন কোন টেকনিক্যাল কাজ না যে আমি পারব না। তার আগে আমাকে দু মাসের ট্রেনিং নিতে হবে। তোমরা দুজন চালিয়ে যাও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব। বাবু এসো!
বাবু সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াল। নায়লার খুব লজ্জা লাগছে, বাইরের একজন মানুষ তার ছেলেকে বাথরুম করাবে, এটা কেমন কথা? মায়লা অস্বস্তি নিয়ে জামানের দিকে তাকাল। জামান স্টেজে লম্বা গিটারিস্টের গান শুনছে। মনে হচ্ছে খুব মন দিয়ে শুনছে। নায়লা বলল, খাবারগুলি তো তেমন ভাল লাগছে না। কোনটাতেই মনে হয়। লবণ হয়নি।
জামান বলল, রুচির ব্যাপার আছে। আমরা তো এইসব খেয়ে অভ্যস্ত না, এই জন্যে আমাদের কাছে ভাল লাগছে না। আমরা খাই ভাজি, ভর্তা, শুটকি, ছোট মাছ …।
নায়লা বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছ না কেন? স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছি কেন?
ছেলেটার নাচানাচি দেখছি। যে ভাবে ঠ্যাং বাকাচ্ছে, মনে হয় ওর একটা হাঁটু না, দুটা হাঁটু।
নায়লা জামানের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। জামান খুব শুকনো মুখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসিকতা করে। হঠাৎ হঠাৎ করে বলেই শুনতে এত মজা লাগে। নায়লা হাসছে–জামান গম্ভীর মুখে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে তার স্ত্রীকে চেনে না।
রাত দশটা বেজে গেছে। জামান ভেবেছিল একটা বেবীটেক্সী নিয়ে চলে যাবে। আলম তাতে রাজি না। সে রেন্ট-এ-কার আনতে পাঠিয়েছে।
জামান বলল, সুন্দর চাদনী রাত আছে। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ শহরে ঘুরে তারপর বাসায় চলে যা। তোর হাই তোলা দেখে মনে হচ্ছে–নিশুতি রাত।
বাবুর মেজাজ এখন খারাপ। সে ঘন ঘন বলছে–মাম্মাট কোলা দুদু। অর্থাৎ তাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে। লজ্জায় নায়লা মরে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছে কি-না কে জানে। বুঝতে পারলে বলে বসবে–বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে, এতে এত লজ্জা কিসের? খাওয়াও। ভদ্রলোকের মুখে কিছু আটকায় না।