নায়লা মুগ্ধ হয়ে হোটেলের সাজসজ্জা দেখছে। সব কিছু কেমন পরিস্কার ঝকঝকে। কোথাও এক কনা ধুলো নেই। কাঠের আসবাবপত্রের দিকে তাকালে মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগে পালিশ করা হয়েছে। দেয়ালে সূর্যাস্তের পেইনটিং। এত সুন্দর যে অকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
আলম বলল, নায়লা, তুমি নিশ্চয়ই হোটেলের বাথরুম দেখতে চাও। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি জানি মেয়ে মাত্রই হোটেলের ঘরে ঢুকলে প্রথম উঁকি দেয় বাথরুমে। কি, দেখতে চাও বাথরুম?
হুঁ।
উঁকি দাও। ঐ যে দরজা।
নায়লা লজ্জিত মুখে বাথরুমের দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল। মার্বেলের মেঝে। এক পাশে বাথটাব। বাথটাব ভর্তি টলটলে পানি। সব কিছু ধবধবে শাদা। বাথটাবটা নীল রঙের বলে পানি হয়েছে হালকা নীল।
জামান বলল, সন্ধ্যে সাতটার দিকে আমি একবার ফাইন্যাল গোসল করি। বাথটাবে পানি ভরেছি–এমন সময় তোমরা এলে।
নায়লা নিজের অজান্তেই বলে ফেলল–আমি কখনো বাথটাবে গোসল করিনি। বলেই খুব লজ্জা পেল। এ ধরনের কথা বলা উচিত না। কেন সে বলল?
আলম বলল, নেমে পড়। কোন অসুবিধা নেই।
বাবু পানিতে যাবার জন্যে ছটফট করছে, আলমের কোলে আর থাকতে চাচ্ছে। না। আলম বলল, জামান, তুই তোর বাচ্চার কাপড়-চোপড় খুলে নেংটো করে দে। ব্যাটাকে পানিতে নামিয়ে দেই। দেখি ব্যাটা কি করে।
জামান বলল, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। শুধু শুধু ঠাণ্ডা লাগবে কেন? গরম পানি। এর মধ্যে ঝাপাঝাপি কবে খুব আরাম পাবে! দে ব্যাটাকে ছেড়ে।
বাবুকে পানিতে ছাড়া হয়েছে। কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে। এখন বাথরুমে শুধু নায়লা এবং বাবু। নায়লা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবুর হাত ধরে সে বসে আছে। বাবু বাথটাবের ভেতরে, সে বাইরে। তার খুব ইচ্ছা করছে বাবুকে কোলে নিয়ে টলটলে পানিতে বসে থাকতে। আরেকদিন এই কাজটা সে অবশ্যই করবে। গোসলের জন্যে বাড়তি কাপড় নিয়ে আসবে।
বাবু বলল, মাম্মাই পানি।
হুঁ পানি। সুন্দর পানি।
মাম্মাট সুন্দল পানি।
সুন্দল না বাবু, বল সুন্দর। সুন্দর পানি।
সুন্দল পানি।
বাবু দুই হাতে পানি ছিটাচ্ছে। পানি ছিটানোর একটা ছবি যদি নেয়া যেত। আলমকে কি বলবে–বাবুর পানি ছিটানোর একটা ছবি নিন। খাক। আরেক দিন।
জামান খাটের উপর খানিকটা জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলম বসেছে খাটের সাইড টেবিলে। আলমের হাতে সিগারেট। আলম বলল, নে, সিগারেট ধরা।
সিগারেট খাব না।
তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?
ক্লান্ত লাগছে। অফিস থেকে আসলাম।
অফিস থেকে এমন আধমরা হয়ে ফিরতে হয়? অফিসে কি করতে হয়? ইট ভাঙতে হয়?
জামান হাসল।
আলম বলল, তুই ডাক্তার-ফাক্তার দেখা। আমার মনে হয় তোর শরীর খারাপ। শরীর ঠিকই আছে।
তোরা আমার এখানে এসে খুব ভাল করেছিস। আমার মনটা ছিল খারাপ।
তোদের দেখে ভাল লাগছে।
মন খারাপ কেন?
অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, বুঝলি–ব্যবসাপাতির খোঁজ-খবর করলাম। কোন ভরসা পাচ্ছি না। সবকিছুই আনস্টেবল। টাকা ইনভেস্ট যে করব, কিসের ভরসায় করব? যেখান থেকে এসেছিলাম আমাকে সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আশা করে এসেছিলাম দেশে থাকব। আশা ভঙ্গ হয়েছে।
তোর আশা ভঙ্গ হবে কেন? ব্যবসাপাতি করে অনেকেই তো খাচ্ছে।
ব্যবসাপাতি সব কিছুতে দু নম্বরী। স্ট্রেইট ব্যবসা বলে এখানে কিছু নেই। আমার সাহসের অভাব কোন কালে ছিল না। এখন সাহসের অভাব বোধ করছি।
তুই তাহলে ফিরে যাবি ঠিক করেছিস?
হুঁ। বিয়ে করব। বউ নিয়ে ভাগবো। আমার বৌ খুঁজে পেয়েছিস?
নায়লা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
গুড। তাড়াতাড়ি করতে হবে। হোটেলে বসে থাকতে এখন আর ভাল লাগছে না। তোর খিদে হয়েছে? খিদে হলে চল খেতে যাই।
বাসায় গিয়ে খাব।
বাসায় গিয়ে খাবি কেন? বাইরের খাবার খাস না? আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করলে ক্ষুর দিয়ে মাথা কামিয়ে দেব।
বাবু শেষ পর্যন্ত পানি থেকে উঠেছে। ঠাণ্ডায় দীর্ঘ সময় থাকার জন্যে তার ঠোঁট নীল হয়ে আছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। নায়লা ভীত গলায় বলল–বাবু কেমন কাঁপছে, ওর জ্বরটর আসবে না তো?
আলম বলল, এত অস্থির হয়ো না নায়ল। বাচ্চাদের শরীর অনেক শক্ত। অল্পতে ওদের কিছু হয় না–চল খেতে যাই। দাও, বাবুকে আমার কোলে দাও।
নায়লা বলল, ও আপনার কোলে যাবে না।
অবশ্যই যাবে। বাবু এসো তো।
বাবু নায়লাকে অবাক করে গুটি গুটি পায়ে অলিমের দিকে এগুতে শুরু করেছে। আলম বলল, শিশুদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারের ক্ষমতা অসাধারণ। অনেক কিছু ওরা বড়দের চেয়ে দ্রুত ধরতে পারে–বাবু ধরে ফেলেছে, এই সুন্দর বাথটাবের মালিক আমি। আবার এই বাথটাবে নামতে হলে আমাকে খুশি রাখতে হব। এই জন্যেই সে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমাকে তার খুব যে পছন্দ–তা কিন্তু না। শিশু এবং মহিলা এই দুই শ্রেণী নিজের স্বার্থ সম্পর্কে খুব সজাগ।
শেরাটনের ডাইনিং হলে খাবারের ব্যবস্থা। এক পাশে গান হচ্ছে। ফর্সা রোগা একটা ছেলে গলায় গিটার বুলিয়ে কৃত্রিম গলায় গাইছে –
Oh my mimi
Oh my mimi …
গানের সঙ্গে যে ভাবে পা নাচ্ছাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে হাঁটু থেকে তার পা খুলে আসবে। বাবু মুগ্ধ হয়ে পা নাচাননা দেখছে। নায়লা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পাশের টেবিলের দিকে। সেই টেবিলে স্বচ্ছ নেটের পোশাক পরে অফ্রিকান এক তরুণী তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে বসেছে। এই পোশাক পরা এবং না পরার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। নায়লা ভেবে পাচ্ছে না একটা মেয়ে কি করে এমন এক পোশাক পরে এত সহজ ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে। আবার কী সুন্দর হাসছে, গল্প করছে।