আপনি আমাকে শয়তান বলছেন?
না, তা না।
প্রকারম্ভিরে তাই বললেন, তবে ভুল বলেন নি। ঠিকই বলেছেন। করিম সাহেব আবার মুখ কালো করে ফেললেন। জামানের মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখতে ভাল লাগে না।
বেতন পেয়ে জামান কখনো খালি হাতে বাসায় ফেরে না। নায়লার রসমালাই খুব পছন্দ। আধা কেজি রসমালাই কেনে। কোন কোন দিন বগুড়ার মিষ্টি দৈ। আজ কিছুই কিনতে মন চাচ্ছে না। নুরুর জন্যে এতগুলি টাকা চলে গেল! এই টাকাটা সামাল কি ভাবে দেয়া হবে সে বুঝতে পারছে না। সংসারে প্রতিটা পয়সা হিসাবের পয়সা। ডালের দাম বেড়ে গেলে ভাল কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। এই অবস্থায় পাঁচ শ টাকা সামলানো মুশকিল। ধার-টার করার উপায় নেই। কার কাছ থেকে ধার করবে? সবার অবস্থাই এক রকম। প্রাইজবন্ড ভাঙাতে হবে। হাজার দুই টাকার প্রাইজবন্ড কেনা আছে। সেগুলা ভাঙাতে হবে।
রাস্তার পাশে গ্যাস বেলুন বিক্রি হচ্ছে। এক একটা বেলুন বিশাল আকৃতির। বাবুর জন্যে কিনতে ইচ্ছা করছে। পাঁচ টাকা দাম শুনে পিছিয়ে পড়ল। পাঁচ টাকা বেলুন কেনার বিলাসিতার সময় এখন না। থাক।
জামান বাড়ি ফিরলো হেঁটে হেঁটে। বেতনের টাকা পকেটে নিয়ে সে বসে উঠে না। বিয়ের পর পর বেতনের টাকা সঙ্গে নিয়ে বাসে উঠেছিল। পকেটমার হয়ে গেল। কি নিদারুণ সমস্যা। ঘরে নতুন বৌ। হাতে নেই টাকা। এর থেকে জামানের একটা শিক্ষা হয়েছে। মাসের এক তারিখে বাসে চড়তে নেই।
সিড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় মনে হল, বাবুর জন্যে বেলুনটা কিনলেই হত। একেক বয়সের জন্যে একেক জিনিস। বেলুনের বয়স পার হয়ে গেলে বেলুন দিয়ে সে কি করবে? সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। আজ লিফটে উঠে পরলে হত।
ছাদে বাবু একা একা খেলছে। হাতে মশারির একটা স্ট্যাণ্ড। বাবুর মাথায় নীল রঙের হ্যাট। হ্যাটের চারদিকে লাল ফিতা। কি সুন্দর লাগছে বাবুকে! জামান ডাকল–এই গুণ্ডু বাবা। গুণ্ডু বাবা।
বাবু ফিরে তাকাল। বাবাকে দেখেই ছুটে আসতে যাচ্ছে। হাতে লম্বা মশারির স্ট্যাণ্ড নিয়ে ছুটে আসাও মুশকিল। এই বুঝি পড়ল। জামনি ছুটে গিয়ে ছেলেকে ধরে ফেলল।
বাবু খিলখিল করে হাসছে।
দরজা ধরে নায়লা এসে দাড়িয়েছে। সে জামানকে আগেই ঢুকতে দেখেছে। নতুন হ্যাটটা মাথায় পরিয়ে বাবুকে দাড় করিয়ে দিয়েছে ছাদে যাতে জামান উপরে ওঠামাত্র বাবুকে দেখে। নায়লা সামান্য অস্বস্তি বোধ করছে। হ্যাট দেখে জামান রাগ করবে কি-না বুঝতে পারছে না।
আজ সে বাবুকে নিয়ে ইস্টার্ন প্লাজায় গিয়েছিল। সেখানে চারতলা পর্যন্ত এসকিলেটর আছে। বাবু এসকিলেটরে চড়তে খুব ভালবাসে। নায়লা ঠিক করেছিল বাবুকে নিয়ে কয়েকবার ওঠানামা করবে, তারপর চলে আসবে। খালি হাতে কোথাও বেরুতে খারাপ লাগে বলে তার হ্যান্ডব্যাগে অলিমের রেখে যাওয়া দুটা নোট নিয়ে গিয়েছিল। এটা কড় ধরনের ভুল হয়েছে। হাতে টাকা আছে বলেই বাবুর জন্যে দুশ টাকা খরচ করে হ্যাটটা কিনে ফেলল। বাবু ঐ দোকানেই একটা ব্যাটারী দেয়া গাড়ি দেখে এমন কান্না শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত গাড়িও কিনতে হল। চলে গেল আরো দুশি। জামানের জন্যে একটা সুয়েটার কিনল। শীত পড়তে শুরু করেছে। সুয়েটার। লাগবেই। গত বছরের স্যুয়েটারটা হারিয়ে গেছে। ছাদে শুকুতে দিয়েছিল, কিছুক্ষণ পর এসে দেখে নেই। সুন্দর ছিল স্যুয়েটারটা। তবে আজকের স্যুয়েটারটা আরো অনেক বেশি সুন্দর–সাদার উপর নীল এবং খয়েরী রঙের ত্রিভুজ। মাখনের মত নরম। দুশ টাকা দাম নিয়েছে, তবু মনে হয় সস্তা হয়েছে।
ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো নায়লা।
কি অদ্ভুত মানুষ! জানে ঘরে ফ্রীজ নেই তবু বলবে, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো। তবে আজ এই অদ্ভুত মানুষের ছোট্ট একটা চমক আছে। খুব ঠাণ্ডা এক বোতল পানি নায়লা এনে রেখেছে। সাততলার এক মহিলার সঙ্গে নায়লার খাতির আছে। তিনি ছাদে কাপড় শুকুতে এলে কিছুক্ষণ নায়লার সঙ্গে গল্স করেন। এক বোতল হিমশীতল পানি নায়লা উনার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে।
জামান গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল–আরে, ঠাণ্ডা পানি দেখছি?
তুমি তো ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলে।
পেয়েছ কোথায়?
তা বলব না। সব রহস্য ভাঙা ঠিক না। আচ্ছা, বাবুর হ্যাটটা কত সুন্দর দেখেছ?
হুঁ। সুন্দর। খুব সুন্দর।
বিদেশী বাচ্চাদের মৃত লাগছে না?
লাগছে।
তুমি তো কিছু বললে না।
আলম কি এসেছিল?
না, অলিম ভাই আসেন নি। দু-একটা শৌখিন জিনিস কি আমি কিনতে পারি না?
টাকা পেয়েছ কোথায়?
টাকা তো আমার কাছে ছিল? ঐ যে তোমার বন্ধু, তোমার সঙ্গে বাজিতে হেরে এক হাজার টাকা রেখে গেল। শোন, আমি কিন্তু সব টাকা খরচ করে ফেলেছি।
জামান তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বলছে না।
প্লীজ, রাগ করো না। এই প্রথম এতগুলি টাকা নিয়ে বাজারে গেলাম। তারপর কেমন যেন মাথায় গোলমাল হয়ে গেল। যা দেখি তাই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে।
আর কি কিনেছ?
বলছি। তার আগে বল তুমি রাগ করেছ কি-না।
না, রাগ করিনি।
বাবুকে কোল থেকে নামিয়ে তুমি বসো। হাঁপাচ্ছে তো।
বাবু কোল থেকে নামবে না। জামানকেও বসতে দেবে না। ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে জামানের কষ্ট হচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় খানিক্ষণ শুয়ে থাকলে ভাল লাগতো।
মেঝের উপর দিয়ে একটা তেলাপোকা হেঁটে যাচ্ছে। বাবু জামানের কোলে নড়েচড়ে উঠল, বাবা, পোকা পোকা।