জামান পাঁচ শ টাকা বের করে দিল। নুরু টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, টাকাটা দিয়ে কি করব জানতে চাইলেন না?
কি করবে?
ইন্দোনেশিয়ান এক জাহাজে চাকরি পেয়েছি। চিটাগাং-এর এক লোক আছে ঐ জাহাজে উঠব। সেই জাহাজ আমেরিকা হয়ে ইউরোপ যাবে। আমি আমেরিকার কাছাকাছি গিয়ে ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যাব। সাঁতরে পাড়ে উঠব।
ভাল কথা, উঠে পড়।
সাঁতার জানি না, এইটাই হল সমস্যা। এক ফাকে সার্তারটা দ্রুত শিখে নিতে হবে। দুলাভাই উঠি?
আচ্ছা উঠ।
ভাংতি দশ-বিশটা টাকা দিন তো দুলাভাই। রিকশাভাড়া। পাঁচ শ টাকার নোট ভাঙিয়ে তো আর রিকশা ভাড়া দেয়া যাবে না।
জামান আরো দশটা টাকা দিল। নুরু ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, দুলাভাই, কাইন্ডলি মুখ থেকে বিমর্ষ ভাবটা দূর করুন। নিজের শালাকে পাঁচ শটা টাকা দিয়েছেন। এমন বড় কিছু না। শালা-শালীদের জন্যে মানুষ অনেক টাকাপয়সা খরচ করে। শালা-শালীরা সাধারণত সিন্দাবাদের ভূতের মত হয়। দুলাভাইদের ঘাড় চেপে থাকে আর নামতে চায় না। সেই তুলনায় আমি বলতে গেলে কখনোই আপনার ঘাড়ে চড়ি না। আর শুনুন দুলাভাই, সিঙ্গারাওয়ালার নামটা জোগাড় করে রাখবেন–প্লীজ। আমি ওর নামটা দিয়ে ক্রেস্ট বানাব। নিচে লেখা থাকবে সিঙ্গাড়া সম্রাট।
জামান মন-খারাপ ভাবটা দূর করার চেষ্টা করছে। পারছে না। পাঁচ শ টাকা অনেকগুলি টাকা। তাছাড়া ব্যাপার এমন না যে আই নুরুর উপদ্রব শেষ। এটা লেগেই থাকবে। যত দিন যাবে তত বাড়বে।
জামান টাকাগুলি বের করে আবার গুনল। এক শ টাকা বেশিই আছে। করিম সাহেব ভুল করেছেন। জামান টাকা ফেরত দিতে গেল।
করিম সাহেব নিতান্ত অবহেলায় এক শ টাকার নোট পকেটে রাখতে রাখতে ললেন, বসুন, চা খেয়ে যান।
চা খাব না। একটু আগে খেয়েছি।
আহা, বসুন না রে ভাই। আপনাকে একটা মজার কথা বলি, ভেবেছিলাম কাউকে কোনদিন বলব না। আপনাকে বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
বলুন।
করিম সাহেবের ঘরে কেউ নেই। বেয়ারা ছিল, তাকে চা আনতে পাঠিয়েছেন। তারপরও তিনি গলা নিচু করে বললেন, মাঝে মাঝে এই কাণ্ডটা আমি করি ইচ্ছা করে। এক শ টাকা বেশি দিয়ে দি। দেখার জন্যে যে বাড়তি টাকাটা পেয়ে আপনারা কি করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? কেউ বলে না, টাকা বেশি হয়েছে। আপনি প্রথম বললেন।
এরকম করার অর্থ কি?
মানুষের অনেক রকম পাগলামি থাকে। এটাও একটা পাগলামি। আমার নিজের ভেতর তো অনেক মন্দ আছে, এই জন্যেই অন্যের মন্দটা দেখতে ভাল লাগে।
এটা ঠিক না।
আমিও জানি এটা ঠিক না। তারপরেও করি। ঠিক কাজের চেয়ে বেঠিক কাজ করতে মানুষের বেশি আনন্দ–এটাও জানেন না?
চা চলে এসেছে। করিম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে আরামের শব্দ করলেন। তাঁকে এখন অনেক প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। তার মনের মেঘ কেটে গেছে।
জামান সাহেব।
জি।
আপনার সঙ্গে এখন যে এক্সপেরিমেন্ট করলাম, সেই এক্সপেরিমেন্ট এখন কুদুস সাহেবের সঙ্গে করব। নিজের চোখে দেখে যান। ভাল লাগবে।
না। খাক।
আহা, দেখুন না রে ভাই। শুধু নিজে কেমন সেটা জানলে তো হবে না–চারপাশের মানুষগুলি কেমন সেটাও জানতে হবে।
করিম সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই, যা ততা কুদ্দুস সাহেবকে বল, আমি সালাম দিয়েছি।
কুদ্দুস সাহেব অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। নামাজ পড়ে পড়ে কপালে দাগ ফেলে। দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহ এবং সোবাহানাল্লাহ এই তিনটি শব্দ ব্যবহার না করে কোন বাক্য বলেন না। অফিসে তার টেবিলে একটি কোরান শরীফ আছে। অফিসে ঢুকে মিনিট পাঁচেক কোরান পাঠ করেন। প্রতি চারমাস পর ঘোষণা দেন–আঙ্গ কোরান, মজিদ শেষ করেছি। আসুন দোয়ায় সামিল হন। দোয়া করা হয়। এটা অফিসের রুটিনের অঙ্গ।
কুদ্দুস সাহেব ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, করিম সাহেব, কি জন্যে ডেকেছেন ভাই?
এম্নি ডেকেছি। আপনি সুফী মানুষ, আপনাকে দেখলে ভাল লাগে। আতর মেখেছেন নকি? সুন্দর গন্ধ দিচ্ছে।
জ্বি, সামান্য দিয়েছি। নবীয়ে করিম দিতেন। আতরের যা দাম! রোজ দিন তো দেয়া সম্ভব না। আজ বেতনের দিন বলে দিলাম।
বসুন ভাই। চা খান।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। চা খাব না, তবে বসলাম। বলুন কি ব্যাপার।
সবার বেতন দিয়ে দেয়ার পর দেখি এক শ টাকা বাড়তি আছে। মনে হয় কাউকে কম দিয়েছি। সবাই আমার সামনে বসে গুনে নিয়েছে। আপনিই শুধু গুনে নেননি। দেখুন তো ভাই আপনাকে কম দিলাম কি না। একটু গুনে দেখুন। কষ্ট দিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না।
কুদুস সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, ঘরে গিয়ে গুনেছিলাম–এক শটা টাকা কম আছে।
আগে বলেন নি কেন?
লজ্জা লাগল। সামান্য কটা টাকা। ভাবলাম…
এরকম কাজ আর কখনো করবেন না কুন্দুল সাহেব। এর পর থেকে সব সময় গুনে নিবেন।
ইনশাআল্লাহ করব।
কুদ্দুস সাহেব টাকা নিয়ে উঠে পড়লেন।
করিম সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। জামান অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। সে নিতান্তই অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটতে দেখল।
করিম সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখলেন জামান সাহেব, এমন একজন ভাল মানুষ অথচ সামান্য এক শ টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না। লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার। এভারেস্ট জয় করা যায় কিন্তু লোভ জয় করা যায় না। সাতাশ বছর ক্যাশ হেন্ডেল করে করে এই কঠিন সত্য শিখেছি।
জামান উঠে পাঁড়াতে সঁড়াতে বলল, মানুষকে ছোট করার জন্য যে কাজটা আপনি করেন এই কাজটা করবেন না। এটা ঠিক না। মানুষকে আপনি লোভ দেখান। আদম এবং হাওয়াকে শয়তান লোভ দেখিয়েছিল।