- বইয়ের নামঃ ছায়াবীথি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
রাত দশটার মত বাজে
রাত দশটার মত বাজে। এমন কিছু রাত না, কিন্তু নায়লার অস্থির লাগছে। গেটে শব্দ হতেই সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ জায়গাটাকে বারান্দা বলা ঠিক না। জায়গাটা ছাদের অংশ। তবু নায়লা বারান্দা বলে। ফ্ল্যাট বাড়ির গেট। কত মানুষ আসছে, কত মানুষ যাচ্ছে।
নায়লা বারান্দায় পঁড়িয়ে রইল। বারান্দা অন্ধকার, বাইরে থেকে তাকে দেখা যাবে না। সে ঠিকই দেখতে পাবে। গেটের কাছে এখন দুশ পাওয়ারের বাতি জ্বলে। এত দূর থেকে মানুষ চেনার কথা না, কিন্তু নায়লা চিনতে পারে।
কাজের মেয়ে ফিরুর মা রান্নাঘর থেকে তাকে ডাকছে। এমন চেঁচিয়ে ঢাকার মানে কি? সে কি বাবুর ঘুম ভাঙাতে চায়? এরা কিছুই শিখবে না? কতবার বলা হয়েছে চেঁচিয়ে ডাকবে না। যা নিষেধ করা হয় এই মহিলা সেটাই বেশি করে।
ও আম্মা। ও আম্মা।
বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে না। যে কোন মুহূর্তে জামান এসে পড়বে। দশটার ভেতর সে সব সময় বাড়ি ফেরে। রিকশা থেকে নেমে সে গেট খুলে ঢুকছে এই দৃশ্য দেখতে নায়লার ভাল লাগে। অন্য কেউ এ কথা শুনলে তাকে পাগল ভাববে। রিকশা থেকে নেমে একটা লোক গেট খুলে বাড়িতে ঢুকছে–এতে ভাল লাগার কি আছে? কিন্তু নায়লার ভাল লাগে। শুধু ভাল লাগা না–শান্তি শান্তি ভাব হয়।
ও আম্মা। আম্মা।
চেঁচাচ্ছ কেন? বাবু উঠে যাবে না?
ভাইজানের গোসলের পানি দিয়া আসমু?
গা জ্বালা-করা কথা। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? গোসলের গরম পানি বাথরুমে দিতে সে বলে এসেছে। ফিরুর মার মাথাটা খারাপ কিনা কে জানে। তাকে আম্মা ডাকছে, অথচ জামানকে ডাকে ভাইজান। ব্যাপারটা তাকে এক লক্ষ বার বলা হয়েছে। যতই বলা হয় ততবারই সে জিবে কামড় দিয়ে বলে, কিচ্ছু মনে থাকে না। ফিরুর শরণের পর থাইক্যা মাখা গেছে আউলাইয়া …
এই এক সমস্যা। যে কোন প্রসঙ্গে সে ফিরুর কথা নিয়ে আসে। সেদিন নতুন চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলল। এক সপ্তাহও হয়নি কেনা হয়েছে। নায়লা কিছু বলার আগেই সে কঁদো কাঁদো গলায় বলল, ফিরুর মরণের পর থাইক্যা কি যে হইছে আম্মা–হাত-পাও কাঁপে।
ও আম্মা। আম্মা। পানি দিমু বাথরুমে?
দাও। আর চেঁচিয়ে কথা বলো না। বাবু উঠে যাবে।
রিক্সা এসে থেমেছে গেটের কাছে। জামান নামছে। এত দূর থেকে মুখ দেখা যায়, কিন্তু নায়লা নামার ভঙ্গি দেখে বলে দিতে পারে। জামানের হাতে কি যেন পোটলা দেখা যাচ্ছে। তার বিশ্রী অভ্যাস হল, দুপুর-রাতে মাছ কেনা। তাও সব মাছ না–ইলিশ মাছ। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রেখে বলবে–ঝটপট দুটা পিস ভেজে দাও তো। কড়া ভাজবে।
রাত-দুপুরে কার মাছ কুটতে ভাল লাগে? তাছাড়া মাছ কাটার পর হাত আঁশটে গন্ধ হয়ে থাকে। সেই গন্ধ সারারাত লেগে থাকে। কি আছে ইলিশ মাছে? শীতকালের ইলিশ কেউ কেনে না। জামনি কিনে আনে।
ফিরুর মা?
জ্বি আম্মা। তরকারী গরম দাও। তোমার ভাইজান এসেছে।
রোজ দিন কেন যে এমুন দিরং করে! শহর-বন্দর জায়গা। একটা বিপদ-আপদ হইলে উপায় আছে?
তোমাকে ওস্তাদী ধরনের কথা বলতে হবে না। তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে, কর।
গেট থেকে ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত আসতে জামানের ঠিক এগারো মিনিট লাগে। এর বেশিও না, এর কমও না। নায়লা ঘড়ি দেখে বের করেছে। দুতলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সময় লাগে। জামান এক নাগাড়ে উঠতে পারে না। থেমে থেমে উঠতে হয়। তাদের একতলা একটা বাড়ি যদি থাকতো। ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি। কয়েকটা নারিকেল গাছ থাকবে বাড়ির সামনে। একটা কঁকড়া আমগাছ। যার ডালে একটা দোলনা কুলবে। বাবু দোলনায় চড়বে। দোলনায় চড়র বয়স বাবুর এখনো হয়নি। খুব শিগগিরই হবে–ছোট বাচ্চারা দেখতে দেখতে বড় হয়। ঐ তো মাত্র সেদিন ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতো! পাশ কি করে ফিরতে হয় তাও জানতো না–আর আজ বাবার চশমা চোখে দিয়ে বলে–আপিস যাব। আপিস যাব।
জামানকে একদিন বলতে হবে ওকে যেন একদিন অফিসে নিয়ে যায়। দেখে আসুক আপিস ব্যাপারটা কি?
কলিংবেল বাজছে।
আজ কি ওর আসতে সময় বেশি লেগেছে? নায়লার মনে হচ্ছে সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।
জামান হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকল। এই ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িগুলি খড়ি। উঠতে গেলে বুকে চাপ পড়ে। সে থেমে থেমে উঠে। এক একটা তালা উঠে খানিকক্ষণ সিড়ির রেলিং ধরে বিশ্রাম করে এটা না করে একটানে আসলে কম পরিশ্রম হবে ভেবে সে একবার একটানে উঠেছিল। এতে এমন সমস্যা হল–দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। হেঁচকির মত উঠে গেল। হার্টের কোন সমস্যাটমস্যা আছে নিশ্চয়ই।
দেখি নায়লা, পানি দাও তো। খুব ঠাণ্ডা পানি।
নায়লা পানি এনে দিল। খুব ঠাণ্ডা পানি দেবার উপায় নেই। ঘরে ফ্রীজ থাকলে তবে তো ঠাণ্ডা পানি। মাঝে মাঝে পাশের সীমাদের ফ্ল্যাট থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে আসে। রোজ রোজ তো আর আনা যায় না। নায়লঃ লক্ষ্য করল, বেচারা ঠাণ্ডা পানি মনে করে খুব আগ্রহ করে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়েই মনটা খারাপ করল। আচ্ছা, সে তো জানে তাদের ফ্রীজ নেই। তারপরও রোজ এসে ঠাণ্ডা পানি চায় কোন যুক্তিতে?
বাথরুমে গরম পানি দেয়া হয়েছে। গোসল করে ফেল।
যাচ্ছি। একটু জিরিয়ে নেই।
মানুষটা মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। দেখতে মায়া লাগছে। এত অল্পতে সে কাহিল হয়? গোসল করে সে চুপচাপ মিনিট পাঁচেক সময় শুয়ে থাকবে–তারপর খেতে আসবে। সেই গোসলও টকটকে গরম পানি ছাড়া হবে না। ভাদ্র মাসের গরমেও তার গোসলের জন্যে গরম পানি চাই।