তোমার মামা জ্ঞানী কথা বলেন না?
না। জ্ঞানী কথা শুনলে তিনি আছাড় দেন। খবর্দার তুমি কোন জ্ঞানী কথা বলতে যাবে না।
উনার নাম কি?
কামরুল ইসলাম। আশ্চর্য তুমি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছ না-কি? মামা অতি অতি অতি ভালমানুষ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।
আসমানীর মামা কামরুল ইসলাম উদোম গায়ে চক্রাবক্রা রঙের বার্মিজ লুঙ্গি পরে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর ভারী। মুখের ভাব গম্ভীর হলেও মানুষটা হাসিখুশি। তিনি এক হাতে নিজের ভুড়িতে থাবা দিতে দিতে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন—তুমি হচ্ছ ফরহাদ?
ফরহাদ উঠে দাঁড়াল।
তিনি বললেন, আসমানী বলছিল তুমি বেঁটে। বেঁটে কোথায়? আমার কাছেতো লম্বাই মনে হচ্ছে। হাইট কত?
পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।
দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি মানে কত সেন্টিমিটার? এক ইঞ্চি সমান কত? ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফোর সেন্টিমিটার না?
আমি বলতে পারছি না।
কাগজ কলম নিয়ে বের করে ফেলতো? কলম আছে?
জ্বি না।
আচ্ছা দাঁড়াও কাগজ কলম কিছুই লাগবে না। ক্যালকুলেটর এনে দিচ্ছি। জাপান থেকে গোটা ছএক ক্যালকুলেটর এনেছি। যাকে যাকে উপহার দিতে ইচ্ছা করছে তাদেরকে শুরুতে একটা অংক করতে দিচ্ছি। তারা যখন অংক নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন গিফট হিসেবে ক্যালকুলেটর। ভাল বুদ্ধি না?
জ্বি।
এইবার তোমার ভাইবা শুরু হচ্ছে। নানান ধরনের প্রশ্ন টশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। প্রথম প্রশ্ন–তোমার সেন্স অব হিউমার কেমন?
ভাল।
তুমি কি মজার মজার কথা বলে লোকজন হাসাতে পার?
জ্বি না।
তাহলে তুমি কি করে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল?
অন্যের কথায় হাসতে পারি।
অর্থাৎ জোকস ধরতে পার?
জ্বি পারি।
আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করেছিস, কি জন্যে করেছিস? সে বলেছে, তার সেন্স অব হিউমার দেখে। সেন্স অব হিউমার প্রসঙ্গে এই কারণেই প্রশ্ন করলাম।
ফরহাদ চুপ করে আছে। মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা দীর্ঘদিন থাকেন তাদের মানসিকতায় সাধারণত দুধরনের পরিবর্তন হয়। একদল হয়ে পড়েন শুকনা কাঠখোট্টা রোবট। আরেক দল হন অতিরিক্ত রকমের সাধারণ মানুষ। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে দ্বিতীয় দলের।
ফরহাদ।
জ্বি।
মেয়েদের কিছু পিকিউলিয়ার ব্যাপার আছে। তারা প্রেমিকের সেন্স অব হিউমার খুব পছন্দ করে কিন্তু স্বামীর সেন্স হিউমার পছন্দ করে না। এটা কি জান?
জি-না।
বিয়ের পর আসমানীর সঙ্গে রসিকতা করলে দেখবে সে বিরক্ত হচ্ছে বা রেগে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তোমার সামান্য রসিকতাতেই হাসবে। ব্যাপারটা আমার কাছে সব সময়ই স্ট্রেঞ্জ মনে হয়। যাই হোক এখন তোমার সম্পর্কে বল—
কি বলব?
তুমি অষুধ কোম্পানীতে আছ?
জ্বি।
কোম্পানীর নাম কি?
ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল।
বিদেশী কোম্পানী?
জ্বি-না। দেশী কোম্পানী।
কাজটা কি?
ছোট কাজ। অষুধের বাক্স নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরা।
কাজটা করতে ভাল লাগে?
জ্বি-না।
অন্য কোন কাজের চেষ্টা করছ?
তেমন কিছু পাচ্ছি না।
বেতন যা পাও—তাতে কি তোমাদের চলে?
জ্বি।
বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না?
না।
নিজের বাড়ি?
জ্বি-না নিজের বাড়ি না।
নিজের বাড়ি না, কিন্তু ভাড়া দিতে হয় না। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি দেশের বাইরে থাকেন।
তোমরা সেই বাড়ির কেয়ার টেকার?
জ্বি।
তোমার আত্মীয় যদি দেশে চলে আসেন তখন কি হবে? কিংবা ধর বিদেশে থেকেই বাড়িটা বিক্রি করে দেন তখন?
ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার পর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
বোনদের বিয়ে হয়েছে?
আমার একটিই বোন। তার বিয়ে হয়েছে।
বোনের স্বামী কি করেন?
ব্যবসা করেন।
বড় ব্যবসা না-কি ছোট ব্যবসা?
ছোট।
নাশতা চলে এসেছে। পরোটা-ভাজি, মুরগির ঝোল, পায়েস। একটা বাটিতে কলা। বিরাট আয়োজন। নাশতা নিয়ে এসেছে আসমানীর ছোটবোন নিশা। মেয়েটা এম্নিতেই গম্ভীর—আজ তাকে আরো গম্ভীর লাগছে।
সে ফরহাদের দিকে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ফরহাদ বলল কেমন আছ নিশা?
নিশা জবাব দিল না। সে ট্রে থেকে টেবিলে নাশতার থালা-বাটি নামাতে ব্যস্ত। এমন ভাব করছে যেন প্রশ্নটা শুনতে পায় নি।
আসমানীর মামা বললেন, ফরহাদ নিশার সঙ্গে তোমার বোধহয় তেমন আলাপ পরিচয় নেই। ও দারুণ রসিক মেয়ে এটা কি তুমি জান?
ফরহাদ বলল, জ্বি-না। জানি না।
ওর গল্পগুজব শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তাকে দেখে অবশ্যি এটা বোঝার কোন উপায়ই নেই। এই নিশা তোর দরজির গল্পটা বলতো।
নিশা গম্ভীর গলায় বলল, গল্পটা মনে নেই মামা।
অবশ্যই মনে আছে বলতো।
নাশতা খাও তারপর বলছি।
আসমানীর মামা বললেন, ও গল্প বলবে না। দাঁড়াও আমিই বলি—এক দরজি তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেছে। সেখানে অন্য এক লোকের সঙ্গে দেখা। লোকটা বলল, এ আপনার ছোট ছেলে না? দরজি বলল, হ্যাঁ। লোকটা বলল, আপনার বড় ছেলেটা কত বড়? দরজি বলল, ছোটটার চেয়ে চাইর গিরা বড়।
ফরহাদ তাকিয়ে আছে। কামরুল ইসলাম সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। তার হাসির কারণে যে সোফায় বসেছিলেন সেই সোফা কাঁপছে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে—শুধু সোফা না, পুরো বাড়িই কাপছে। ফরহাদের হাসি আসছে না। বাড়িঘর কাঁপিয়ে হাবার মত কোন গল্পও এটা না। কিন্তু ভদ্রলোক এমন হাসছেন কেন?