গভীর রাতে ফার্মগেট পেট্রোল পাম্পের কাছে গেলে কেমন হয়। ঐ মেয়েটিকে হয়ত সেখানে পাওয়া যাবে। নিশিকন্যারাও এক অর্থে ভিক্ষুকদের মত। ভিক্ষুকরা যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় ভিক্ষা করে, এরাও তাই করে, নিদৃষ্ট জায়গায় সেজেগুজে št তাকে বললেই হবে অনেক দিন আগে তোমাকে দেখে হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কার মত খেয়েছিলাম। কারণ তোমার চেহারা দেখতে আমার অতি প্রিয় একজনের মত। তখন আমার হাতে এক হাড়ি বগুড়ার দৈ ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল দৈ এর হাড়িটা তোমাকে দিতে। কেন জানি দেয়া হয় নি। আজ নিয়ে এসেছি। আমি খুবই খুশি হব যদি তুমি দৈটা নাও। তুমি ভাল থেকো কেমন? আমার অতি প্রিয়জনের নামটা জানতে চাও? ওর নাম আসমানী। ওর কোন ছবি আমার কাছে নেই। ছবি থাকলে দেখতে ওর সঙ্গে তোমার চেহারার কি অদ্ভুত মিল।
জাহানারাদের বাড়িতে একবার যাওয়া যায়। বাবার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। ঐ বাড়িতে সে অনেকবার গিয়েছে। তাকে পাওয়া যায় নি। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। কোন রকম কাজ কর্ম নেই মানুষ সবচে ব্যস্ত থাকে। কাজের মানুষদের বাড়ি ঘরে পাওয়া যায়। অকাজের মানুষদের কখনোই পাওয়া যায় না।
জাহানারাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় জোবেদ আলি কি গাছের যেন চারা পুঁতছেন। ছেলেকে দেখে বিস্মিত গলায় বললেন, আরে তুই।
ফরহাদ বলল, কেমন আছ বাবা? আমি প্রায়ই আসি। তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। যাক আজকে দেখা হয়ে গেল। কি করছ?
জমি ঠিক করছি। এ জায়গার মাটি ভাল। গাছ ঠাই ঠাই করে বড় হবে। তোর কি শরীর খারাপ না-কি। তোকে কেমন অদ্ভুত লাগছে।
চুল কাটিয়েছি মনে হয় এই জন্যে।
শরীরের যত্ন নিবি বুঝলি। একসারসাইজ করবি। আমার নিজের শরীরটা যে ভাল আছে তার প্রধান কারণ এই বুড়ো বয়সেও কোদাল দিয়ে মাটি কোপাই। শরীর ঠিক রাখার জন্যে সবারই একসারসাইজ দরকার শুধু গাছের বেলায় ভিন্ন ব্যবস্থা। গাছের একসারসাইজ লাগে না।
ফরহাদ হাসল। জোবেদ আলি বললেন, তোর কাছে টাকা থাকলে আমাকে শ দুই টাকা দিয়ে যা। দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা নিয়েছিলাম এই নিয়ে হুলুস্থুল ব্যাপার হয়ে গেছে। এত লোক থাকতে দারোয়ানের কাছ থেকে কেন টাকা ধার করলাম। বড়লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করলে সমস্যা নেই। দারোয়ান টাইপ মানুষদের কাছ থেকে টাকা ধার করলেই সমস্যা। আছে তোর কাছে টাকা?
ফরহাদ দুশ টাকা বের করে দিল। জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, যদি থাকে আরো একশটা টাকা দিয়ে যা। ছেলের কাছ থেকে ভিক্ষুকের মত টাকা নিতে হচ্ছে। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমার এই অপমানটা হচ্ছে। মানুষ না হয়ে গাছ হয়ে জন্মালে আমার এই অপমানটা হত না। তুই কখনো শুনেছিস একটা বটগাছ, চারা বট গাছের কাছে কোন জিনিস ধার চাইছে।
গাছ ছাড়া তুমি আর কিছু ভাব না বাবা?
গাছ নিয়ে ভাবা কি অন্যায়?
ফরহাদ বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, কোন অন্যায় না। তুমি যেহেতু মানুষ, গাছ না। সেহেতু মাঝে মধ্যে আশেপাশের মানুষদের কথাও ভাববে।
ভাবি না তোকে কে বলল। ভাবিতো। খুবই ভাবি।
না বাবা তুমি ভাব না। একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। দাদাজান মারা যাওয়ায় বিয়েটা হয় নি। তারপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তুমি কখনো তার কথা জানতে চাও নি। মেয়েটাকে একবার দেখতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করোনি।
জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, চল যাই দেখা করে আসি। আজই যাই। হাত ধুয়ে লুঙ্গি বদলে পাজামা পরে আসি। পাঁচ মিনিটের মামলা। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। হরলিক্স, ডাব, কলা, এইসব নিয়ে যেতে হবে। তোর কাছে টাকা আছে না?
ও দেশে নেই বাবা। চিকিত্সার জন্যে বাইরে গেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল হয়ে আসুক, তারপর ইনশাল্লাহ দেখতে যাব। তোর কাছে সিগারেট থাকলে দেতো খাই।
ফরহাদ সিগারেট দিল। জোবেদ আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ঐ মেয়েটার কথা যে কিছু জিজ্ঞেস করি না, তোর মায়ের ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। তোর মার ধারণা আমাদের সংসারে এত সব ঝামেলা যে হচ্ছে সব ঐ মেয়েটার জন্যে হচ্ছে।
তার মানে?
ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হল। তোর চাকরি চলে গেল। বিয়ের দিন তোর দাদাজান মারা গেলেন। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। এখন পরের বাড়িতে অনুদাস হয়ে আছি।
তুমি কি মার কথা বিশ্বাস কর?
তুই পাগল হয়েছিস? তোর মা যখন সত্যি কথা বলে তখনো আমি বিশ্বাস করি না। ঐ দিন মঞ্জু টাকার জন্যে এসেছিল—কি কান্নাকাটি। তোর মা তাকে একটা পয়সা দেয় নি। শেষে সে এসেছে আমার কাছে। আমি জন্মদাতা পিতা। বিপদে পড়লে আমার কাছেতো আসবেই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা আমাকে টাকা জোগাড় করে দাও।
ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, ওর টাকা দরকার কেন?
জানি না কেন। আজকাল আমি কিছু জানতে চাই না। জানতে চেয়েতো কোন লাভ নেই। কিছু করতে পারব না। শুধু শুধু জেনে কি হবে। চা খাবি রে ব্যাটা?
চা? বাড়িতে চা খেয়ে লাভ নেই, বাসার সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে চল। সেখানে বাপ বেটায় চা খাই। ওরা চা-টা ভাল বানায়।
চল যাই।
জোবেদ আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে আমি ভালই আছি। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কাজে কর্মে ব্যস্ত আছি। তবে মাঝে মধ্যে পুরানো দিনের কথা মনে হয়। তখন মনটা খুব খারাপ হয়।
পুরানো কোন কথা?
তুই যখন চাকরি করতি। ঢাকার বাইরে থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরতি। বাপ ব্যাটা এক সঙ্গে ভাত খেতাম। মনে নেই ঔ যে কাতল মাছের বিরাট এক মাথা তুই আমার পাতে তুলে দিলি। তবে এইসব ভেবে মন খারাপ করি না। মন খারাপ করলেতো কোন লাভ নেই। শুধু শুধু মন খারাপ করব কেন?
নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন
নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন। পোলাও এবং মুরগির কোরমা। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে কারণ অর্ণব খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আজ রাতে সে। বাবার সঙ্গে থাকবে। অর্ণব গভীর আগ্রহে বাবার কর্মকান্ড দেখছে। নান্টু ভাই। ছেলের আগ্রহ দেখেও মজা পাচ্ছেন। তিনি ফরহাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ফরহাদ এলে তাকে ডিম আনতে পাঠাবেন। ফার্মের ডিম না, দেশী ডিম। ডিমের পুডিং বানাতে হবে। ডিমের পুডিং ছেলের খুব পছন্দ। রান্না শেষ করেই ভিডিওর দোকানে যেতে হবে। মিকি মাউসের ক্যাসেট আনতে হবে। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা বেটা মিলে ক্যাসেট দেখা হবে। যে ভাবেই হোক ছেলেকে আনন্দে রাখতে হবে। আজ অর্ণবের দুঃখের দিন। কারণ আজ সন্ধ্যায় তার মার বিয়ে। মা-বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে ছেলে মেয়ের উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ। সেই জন্যেই বোধ হয় শর্মিলা এত সহজে ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে।