আমি তোমায় ভালবাসি
চিঠি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় তারপরেও মনে হয় চিঠি পড়া হয় নি। যে কথাগুলি লেখা হয়েছে তার বাইরেও অনেক কিছু লেখা। বাইরের লেখাগুলি পড়তে সময় লাগে। রাত তিনটার সময় চলে আসবে। এর মানে কি? এটা কি শুধু কথার কথা? না সে সত্যি চাচ্ছে গভীর রাতে সে গিয়ে উপস্থিত হবে?
বৃষ্টি পড়ছে। ঘর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। জানালা খোলা, বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দাদাজান ঘরে না থাকলে সে জানালা খোলা রাখত। ঘুমের মধ্যে হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টির কণা চোখে মুখে পড়া আনন্দের ব্যাপার। ফরহাদ জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে গেল। ঘুম এসে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। শুধু ঘুম না, ঘুমের সঙ্গে স্বপ্ন। স্বপ্নেও বৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টির মধ্যে দৈ-এর হাড়ি নিয়ে ভিজছে। সে দাঁড়িয়ে আছে পেট্রল পাম্পের ভেতর। মাথার উপরে ছাদ। তার গায়ে বৃষ্টি পড়ার কথা না। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারগুলি স্বপ্নেই সম্ভব। পেট্রল পাম্পে তার সঙ্গে আরেকটা মেয়ে ভিজছে। এই মেয়েটা দেখতে অবিকল আসমানীর মত, কিন্তু সে আসমানী না। এই মেয়েটা নিশিকন্যা। মেয়েটা ভিজে জবজবা হয়ে গেছে। ফরহাদ বলল, এই শোন এদিকে আস। মেয়েটা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।
ফরহাদ বলল, নাও এই দৈয়ের হাড়িটা নাও।
কেন?
বাসায় নিয়ে যাও। বাসায় নিয়ে খাবে।
উঁহু।
উঁহু কি নিয়ে যাও। নাম কি তোমার?
আমার নাম আসমানী।
আমার সঙ্গে ফাজলামী করবে না। তোমার নাম আসমানী না।
সত্যি আমার নাম আসমানী।
এই সময় খুব ভারী এবং গম্ভীর গলায় কেউ একজন বলল, ঐ মেয়ে সত্য কথা বলছে। তার নাম আসমানী।
ফরহাদ ঘুমের মধ্যেই প্রচন্ড চমকে উঠে বলল, কে কে কথা বলল।
মেয়েটা বলল, আপনার দাদাজান।
তাইতো। দাদাজানেরইতো গলা। তিনি এখানে এলেন কেন? এই বয়সে বৃষ্টিতে ভিজলে উপায় আছে। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। দাদাজানেরই গলার আওয়াজ। মনে হচ্ছে কেউ তাকে গলা চেপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ফরহাদ ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। দাদাজানকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার গোঁ গোঁ চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
ফরহাদ জেগে উঠল। পাশের খাটে দাদাজান সত্যি সত্যি গোঁ গোঁ করছেন। তাকে বোবায় ধরেছে। ফরহাদ উঠে গিয়ে দাদাজানের কপালে হাত রাখতেই তিনি বললেন–পানি খাব। পানি।
দাদাজানের শরীর কাঁপছে। ঘামে তার মুখ ভিজে জবজব হয়ে গেছে। তিনি দুহাতে ফরহাদ শক্ত করে ধরে আছেন এবং বিড়বিড় করে বলছেন—পানি, পানি।
আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়িতে ফরহাদ
আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়িতে ফরহাদ এর আগেও এসেছে।
ফ্ল্যাট বাড়িগুলি এম্নিতেই ছিমছাম ধরনের থাকে—এইটা আরো বেশি ছিমছাম। নানান কায়দাকানুন। গেটে দারোয়ানের কাছে বইতে নাম লেখতে হয়। দারোয়ান তারপর ইন্টারকম করে। ইন্টারকমে যদি ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায় তবেই লিফটে ওঠা যায়। ক্লিয়ারেন্স পাবার পরও দারোয়ান এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন একজন ভয়ংকর অপরাধী লিফট করে উঠে যাচ্ছে।
বাড়িতে ঢোকার পরেও সমস্যা। মনে হয় কোন হোটেলে ঢুকে পরা হয়েছে। বসার ঘর এমন করে সাজানো যে সহজ হয়ে বসা যায় না। ফরহাদের প্রধান সমস্যা হয়—জুতা পায়ে দিয়ে সে কার্পেটে উঠবে, না-কি জুতা খুলে উঠবে? জুতা যদি খুলে তাহলে জুতা রাখবে কোথায়? বসার ঘরে ঢোকার আগে দরজার পাশে, না-কি বসার ঘরের কার্পেটে। এখানে থাকা মানেই সারাক্ষণই এক ধরনের টেনশান। বসার ঘরটা কি স্মোক-ফ্রি জোন? না-কি সিগারেট খাওয়া যায়। সিগারেট খেলে ছাই কোথায় ফেলবে? একবার ছাইদানীতে ছাই ফেলার পর আসমানী ভুরু কুচকে বলল—কোথায় ছাই ফেললে? এটা এসট্রে না। মোমদানী। নিচে নোম লেগে আছে দেখেও বুঝতে পারলে না? আশ্চর্যতো। তারপর সে কাজের মেয়েটাকে ডাকল মোমদানীর ছাই ফেলে ধুয়ে আনার জন্যে। কাজের মেয়েটা এসে এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন সে বাংলাদেশের মহা বেকুবদের একজন প্রতিনিধি। মোমদানী এবং এসট্রের সামান্য প্রভেদটাও জানে না।
ফরহাদের ধারণা আসমানী ছাড়া এ বাড়ির একটা মানুষও তাকে দেখতে পারে। যেমন আসমানীর বাবা নেজাম উদ্দিন। ভদ্রলোক ব্যাংকার ছিলেন—এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। রিটায়ার্ড লোকজন নিজের সংসারে তেমন পাত্তা পায় না বলে—বাইরের লোকজনের সঙ্গে তাদের ব্যবহার খুব আন্তরিক হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম সম্ভবত নেজামত সাহেব। ফরহাদকে দেখলেই তিনি চোখ মুখ কঠিন করে ফেলেন। প্রফেশনাল উকিলদের মত জেরা করতে থাকেন। জেরার ফাঁকে ফাঁকে এমন দুএকটা কথা বলেন যে রাগে রক্ত গরম হয়ে যায়। যেমন একবার নেজামত সাহেবের দেখা হল। ফরহাদ এসে ঢুকেছে তিনি বেরুচ্ছেন এমন অবস্থায় দেখা। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কঠিন করে ফেললেন। ভুরু কুচকে গেল। চোখ সরু হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, তুমি কে? কাকে চাও?
ভদ্রলোক ভাল করেই জানেন ফরহাদ কে? এবং সে কার কাছে এসেছে। তারপরেও জিজ্ঞেস করা। ফরহাদ কাচু মাচু ভঙ্গিতে বলল, জি আমার নাম ফরহাদ। আমি আসমানীর কাছে এসেছি। ওকি বাসায় আছে?
ও আচ্ছা আচ্ছা। তোমাকেতো আরো কয়েকবার দেখেছি। তোমার দেশ যেন কোথায়?
জ্বি নেত্রকোনা।
নেত্রকোনার লোকদের বিশেষত্ব কি বল দেখি।
ফরহাদ চুপ করে রইল। ভদ্রলোক বললেন—নেত্রকোনার বিশেষত্ব হচ্ছে এই অঞ্চলের লোকজন সব সময় উল্টা ভাব ধরে থাকে। বুঝতে পেরেছ কি বললাম?