রাহেলার মন আজ বেশ ভাল।
বড় মাছটা আনায় খুব কাজ হয়েছে। মাছটা শুধু যে বড় ছিল তা-না, স্বাদু মাছ ছিল। জাহানারার শাশুড়ি পর্যন্ত বললেন, অনেক দিন পর এত ভাল মাছ খেলাম। টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা।
রাহেলা খুশি খুশি গলায় বললেন, ফরহাদকে বলব ভাল পাংগাস মাছ দিয়ে যেতে। ও মাছ চেনে। খুব সকালে আরিচা ঘাটে যাবে। ফ্রেশ মাছ কিনে নিয়ে আসবে। দেখি কাল পরশুর মধ্যে…।
জাহানারার শাশুড়ি বললেন, এইসব কি বলছেন বেয়ান। রোজ রোজ মাছ কিনতে হবে না-কি।
রাহেলা তৃপ্তির গলায় বললেন, রোজ রোজ কি আর কিনছি না-কি? আছি আর মাত্র দুই চারদিন। সবাইকে নিয়ে পাংগাস মাছ একটা না হয় খেলাম।
দুই চারদিন আছেন না-কি?
জ্বি বেয়ান। মঞ্জু বাসা ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। আমি খুবই রাগ করেছি। বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠাবি কেন? তুই নিজে এসে দিবি না। তুই কোথাকার তালেবর?
ব্যস্ত থাকে।
ওর ব্যস্ততার কথা আমাকে বলবেন না বেয়ান। যত ব্যস্ততা বাবা-মার বেলায়। বন্ধু বান্ধবের বেলায় হাতে অবসর আছে। বেয়ান আমি ঠিক করেছি ওর বিয়ে দেব। একটা মেয়ে দেখবেন তো। মেয়েটা সুন্দর হতে হবে, আর ভাল বংশ। ছেলেতো আপনি দেখেছেন। শিক্ষক বাবার ছেলে আর কিছু থাকুক না থাকুক চরিত্র ঠিক আছে।
তাতো থাকবেই।
ওর বয়েসী ছেলেদের তো বেয়ান দেখি—মদ খাচ্ছে, গাঁজা খাচ্ছে আবার ফেনসিডিল খাচ্ছে। ওদের সঙ্গে যখন আমার দুই ছেলেকে মিলাই তখন বড় শান্তি লাগে। মনে মনে বলি—আল্লাহপাক তোমার দরবারে হাজার শুকুর।
বেয়ান আপনার কথা শুনে ভাল লাগল।
মঞ্জুর একটা ঘটনা বলি বেয়ান। একদিন রিকশা করে এসেছে। রিকশা ভাড়া দশ টাকা। আমার কাছে বলল–মা দশটা টাকা আছে। আমার কাছে সব বড় নোট। আমি দিলাম দশ টাকা! ও আল্লা তারপর থেকে দেখি কয়েকদিন পর পর ঐ রিকশাওয়ালা আসে। আমাকে সালাম করার জন্যে আসে। আমি ভাবলাম ব্যাপার কি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম। রিকশাওয়ালা বলল, স্যার ঐ দিন তার দুঃখের কথা শুনে পাঁচশ টাকা বখশিস দিয়েছেন। এখন বেয়ান আমার কথা হল তুই যদি পাঁচশ টাকাই দিবি। তাহলে দশ টাকা ভাড়া দেয়ার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?
রাহেলা ছেলের গল্প আরো কিছুক্ষণ করতেন, মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে থেমে গেলেন। জাহানারা থমথমে গলায় বলল, মা একটু বাইরে এসোতো।
রাহেলা শংকিত গলায় বললেন, কি হয়েছে?
জাহানারা বলল, কিছু হয় নি একটু বাইরে এসো কথা আছে।
রাহেলা মেয়ের সঙ্গে বারান্দায় গেলেন। জাহানারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমরা কি আমার সামান্য মান সম্মানও রাখবে না?
কেন কি হয়েছে?
জাহানারা চাপা গলায় বলল, মজু ভাইয়া তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়েছিল। তার না-কি পার্টনারের সঙ্গে কি সমস্যা হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার টাকার জোগাড় না হলে জেলে যাবে। টাকার জন্যে তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। মদ খেয়ে গিয়েছিল। হুঁস জ্ঞান নেই জামাইয়ের পায়ে ধরতে যায়।
রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—জামাই কি টাকা দিয়েছে?
তোমার জামাইতো হাজি মুহম্মদ মহসিন না। কেউ চাইবে আর টাকা বের করে দিয়ে দেবে। সে খুবই বিরক্ত হয়েছে এবং আমার উপর রাগ করেছে।
তোর উপর রাগ করার কি আছে? তুইতো আর টাকা চাস নাই।
আমার বাপ ভাইতো চেয়েছে। পায়ে ধরে চেয়েছে। একবার চেয়েওতো কেউ চুপ করবে না। চাইতেই থাকবে।
আমাকে এইসব বলছিস কেন? আমি কি করব?
তুমি চারদিকে যে উল্টাপাল্টা গল্প করছ এইগুলি বন্ধ করবে। মঞ্জু ভাইয়ার কাছে খবর পাঠাবে সে যেন তোমার জামাইয়ের অফিসে ভুলেও না যায়। আর এখানেও যেন না আসে।
ও কোথায় থাকে তাইতো আমি জানি না।
জাহানারা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি একটা কাজ কর মা। বাবাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও। তোমাদের জন্যে আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাবা কি করেছে তুমি জান? দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা ধার করেছে।
রাহেলা বললেন, আমরা যাব কোথায়?
জানি না কোথায় যাবে। আমার অসহ্য লাগছে মা। মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
জাহানারা খুব কান্নাকাটি করলেও রাহেলা স্বাভাবিক রইলেন। অন্যদিনের মতই তাকে হাসি খুশি মনে হল। আজ বৃহস্পতিবার। রাতে আক্তারী বেগম এলেন। রাহেলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে খুবই আগ্রহের সঙ্গে ধর্মের কথা শুনতে গেলেন। যেন আজ কোন ঘটনাই ঘটে নি। আজকের আলোচনার বিষয় আছর ওয়াক্তের গুরুত্ব।
আক্তারী বেগম বলছেন—আছর ওয়াক্তের মত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াক্ত আর নাই। কেন জানেন? জানেন না? মিলাদ, কোরানখানির দোয়া সব আছর ওয়াক্তে হয় না? কেন হয় এই কথাটাকি কখনো মনে আসে না? আচ্ছা শুনেন বলি——আছর ওয়াক্তে রোজকেয়ামত হবে। আবার এই আছর ওয়াক্তেই বাবা আদম গন্ধম ফল খেয়েছেন। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে কখন বের হয়েছিলেন? ঠিক আছর ওয়াক্তে। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে বের হয়ে প্রথম যে কাজটা করেন তা হল পাক পবিত্র হয়ে দুই রাকাত শোকরানা নামায আদায় করেন। মাছের পেটে বসে ইউনুস নবী যে দোয়াটা পড়েছিলেন, সেই দোয়াটা দিয়ে আজ আমরা জিকির করব। বলেন লা ইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজুয়ালেমিন।
জিকির হচ্ছে। রাহেলা বেগম চোখ বন্ধ করে গভীর মনযোগে মাথা ঝুঁকিয়ে জিকির করছেন। জাহানারা এসে মার কাঁধে হাত দিয়ে চাপা গলায় বলল, মা তুমি তোমার ঘরে যাও। মঞ্জু ভাইয়া এসেছে। তোমার ঘরে বসে আছে। তুমি অতি দ্রুত তাকে বিদায় কর। তোমার জামাই যদি শুনে সে এখানে এসেছে তাহলে খুবই রাগ করবে।