আমি কিছু জানতে চাচ্ছি না।
তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার AML হয়েছে।
AML টা কি?
আরেক ধরনের ব্লাড ক্যানসার—একুউট মায়ালোজেনাস লিউকোমিয়া। মায়ালোজেনাস আবার দুরকমের হয়। মাইলোমনোসাইটিক এবং পিউর মনোসাইটিক। শুনতে বিরক্ত লাগছে?
লাগছে।
আমার ইয়াং ডাক্তার সাহেবের কাছে শুনলাম বিদেশে যাদের এ ধরনের ভয়াবহ অসুখ হয় তাদেরকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা থাকে। সাইকিয়াট্রিস্টরা এসে দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে কথা বলেন। মৃত্যুর জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেন। হাস্যকর না?
হাস্যকর কেন?
যাদের এ ধরনের অসুখ হয় তারা মৃত্যুর জন্যে আপনা থেকেই তৈরী হয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার রুগীর আত্মীয় স্বজনদের জন্যে। তার প্রিয়জনদের জন্যে। যেমন তোমার জন্যে দরকার হবে। তুমি এক কাজ কর বিছানায় পা তোলে আরাম করে বোস। তুমি এমন ভাবে বসেছ যে দেখে মনে হচ্ছে ভাইভা পরীক্ষা দিতে বসেছ। এবং আমি হচ্ছি ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান।
ফরহাদ পা তুলে বসল। আসমানী বলল, আমি খুব শিগগীরই চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছি।
কবে যাচ্ছ?
কবে তা বলব না। কারণ বললেই তুমি এয়ারপোর্টে উপস্থিত হবে। তোমাকে দেখে তখন ভয়ংকর ধরনের কষ্ট হবে। তোমাকে এখানে রেখে চলে যাচ্ছি। আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। এই কষ্টটা আমার সহ্য হবে না। যখন চাকরি করতে। চাকরির প্রয়োজন দুদিন, তিন দিনের জন্যে বাইরে যেতে তখনও সহ্য হত না। সারারাত ঘুমুতে পারতাম না। ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। কাজেই আমি কবে দেশের বাইরে যাচ্ছি তা তোমাকে জানাব না। তুমি হঠাৎ একদিন শুনবে আমি চলে গেছি। দেখবে দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে।
ফরহাদ কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল আসমানীর দিকে। আসমানীর গলার স্বর কি সামান্য বদলেছে? একটু যেন অন্যরকম লাগছে। আসমানী বলল, বাবার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয়েছে না?
হ্যাঁ।
তাকে আগের চেয়ে অনেক হাসিখুশি লাগে নি?
বুঝতে পারি নি।
বাবা খুশি কারণ মেয়ের চিকিৎসার জন্যে তাঁকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমার চিকিৎসার জন্যে কে টাকা দিচ্ছেন জান?
না।
আনিস সাহেব নামের এক ভদ্রলোক। তাঁর কথা তোমাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। ঐ যে মামা যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। ভাগ্যিস ঐ ভদ্রলোক আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার সঙ্গে গল্প-টল্প করেছিলেন। তা না করলে আমার প্রতি তাঁর মমতা তৈরী হত না। টাকা পয়সা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করার জন্যেও এগিয়ে আসতেন না। আমি মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়ে অদ্ভুত সব যোগাযোগের কথা ভাবি। মজার ব্যাপার কি জান আনিস সাহেব কিন্তু আমাকে হাসপাতালে বা বাসায় দেখতে আসেন নি। অথচ উনি ঢাকাতেই আছেন। অদ্ভুত না?
হ্যাঁ অদ্ভুত।
খুব পরিচিত অনেকেই আমাকে দেখতে আসে নি। যেমন কণা। আমার এত প্রিয় বান্ধবী। কিন্তু সে আসে নি। আবার কেউ কেউ এসেছে যাদের সঙ্গে অতি সামান্য পরিচয়। এমন একজনও এসেছে যাকে আমি কোনদিন দেখিনি।
সে কে?
খুব সুন্দর মত একটা মেয়ে। তোমাকে মনে হয় চেনে। মেয়েটা বিপদে পড়েছিল তুমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। এমন কারো কথা কি মনে পড়ছে?
না। মেয়েটা তোমাকে চেনে কি ভাবে?
জানি না। জিজ্ঞেসও করি নি। আমার এখন এমন সময় যাচ্ছে যেখানে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। তবে আমি নিশ্চিত মেয়েটা তোমাকে খুব ভালমত চেনে। শুধু চেনে না, তোমাকে অসম্ভব পছন্দও করে। সে যেহেতু চেনে তুমিও চেন। একটু মনে করার চেষ্টা করলেই মনে পড়বে। মেয়েটার চিবুকে কাটা দাগ আছে। চোখও ছোট বড় আছে। ডান চোখটা বা চোখের চেয়ে সামান্য বড়। চট করে বোঝা যায় না, ভাল করে তাকালে বোঝা যায়।
এমন করে বর্ণনা দিচ্ছ কেন?
বর্ণনা দিচ্ছি যাতে তুমি মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পার।
নাম বলে নি?
নাম বলেছে কিন্তু নামটা তোমাকে বলব না। মেয়েটাকে তোমার খুঁজে বের করতে হবে।
তার কি কোন দরকার আছে?
হ্যাঁ দরকার আছে। আমার অসুখটা সারবে না। আমি চাই আমি যেমন তোমাকে ভালবেসেছি তেমন কেউ তোমাকে ভালবাসুক।
আসমানী তুমি খুবই উদ্ভট কথা বলছ?
আসমানী হাসতে হাসতে বলল, অসুখে মাথার ঠিক নেই। উদ্ভট কথা বলতেও পারি। আচ্ছা তোমার দাদাজানের সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল না? তুমি তার অনেক সেবাযত্ন করতে। রাতের বেলা দাদা নাতী মিলে গুটুর গুটুর করতে। করতে না?
হ্যাঁ করতাম।
এখন কি সেই দাদাজানের কথা তুমি ভাব? ভাব না। জীবিত মানুষরা অতি দ্রুত মৃত মানুষদের কথা ভুলে যায়। এখন তোমার আমার জন্যে খুব কষ্ট হবে কারণ আমি জীবিত। আমি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতি তোমার ভালবাসা অতি দ্রুত কমতে শুরু করবে। এত দ্রুত কমবে যে তোমার নিজেরই লজ্জা। লাগবে। আচ্ছা শোন আমি অনেকক্ষণ ধরে বকবক করেছি। এখন আমার মাথা ধরে গেছে। শরীর ঝিমঝিম করছে। তুমি কি দয়া করে উঠবে?
ফরহাদ উঠল না আগের মত বসে রইল।
আসমানী বলল, তোমার হাতের এই শাড়িটা কি আমার জন্যে?
হ্যাঁ। তোমার বিয়ের শাড়ি।
বিয়ে হলে তবে না বিয়ের শাড়ি পরব। এই শাড়ি তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। যদি ভাল হয়ে দেশে ফিরি তখন শাড়ি নিয়ে এসো। খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়ি পরব। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
আসমানী চোখ বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার শরীর কাঁপছে। জগৎ সংসার অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তার খুব ইচ্ছা করছে সে ফরহাদকে বলে—খবর্দার তুমি যাবে না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে থাকবে। যার যা ইচ্ছা ভাবুক। আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তা সম্ভব না। আমরা অসম্ভবের জগতে বাস করি না।