মেঘ কালো আঁধার কালো আর কলংক যে কালো।
ফরহাদ নিউ মার্কেটের দিকে রওনা হল। রাইমসের বইটা কিনে, মাছ কিনতে ঢুকবে। এর মধ্যে যদি ভালমত বৃষ্টি নামে তাহলে মাছের দাম কমে যাবে। বৃষ্টির দিনে ইলিশ মাছের দাম বাড়ে। অন্য সব মাছের দাম কমে যায়।
মানুষের মন যদি এ রকম হত যে সে একসঙ্গে একটার বেশি কোন কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না তাহলে চমৎকার হত। মনটাকে সব সময় কোন না কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা যেতে পারত। কিন্তু মানুষের মন এক সঙ্গে দশ বারোটা বিষয় নিয়ে ভাবতে পারে। ফরহাদ নিশ্চিত যে যখন মাছের বাজারে ঢুকে রুই এবং কাতল মাছের দাম কমাতে ব্যস্ত থাকবে তখনো তার মনের একটা অংশ ভাববে আসমানীর কথা। কেমন আছে আসমানী? আজ যদি বৃষ্টি নামে সে কি তার বিছানার জানালা থেকে বৃষ্টি দেখবে? রোগ যন্ত্রণায় কাতর মানুষ কি বৃষ্টি পছন্দ করে?
দরজা খুলে রাণী অবাক। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কানকোয় দড়ি বাধা বিশাল একটা কাতল মাছ। ফরহাদ ব্ৰিত গলায় বলল, বাড়িতে কোন কাজের লোক আছে। মাছটা ভেতরে নেবে।
রাণী অবাক হয়ে বলল, মাছ কেন?
মা বলেছেন একটা বড় মাছ কিনে তোমাদের এখানে দিয়ে যেতে। মাকে একটু খবর দেবে?।
উনি এখন বাড়িতে নেই। পাশের বাড়িতে মিলাদ হচ্ছে—মিলাদে গেছেন। উনি যেতে চান নি আমার মা জোর করে নিয়ে গেছেন।
তুমি মাকে বলে দিও যে মাছ দিয়ে গেছি।
আপনি কি এখন চলে যাবেন?
হ্যাঁ।
বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবেন? অবশ্যই যাবেন না। উনারা চলে আসবেন আমি খবর পাঠাচ্ছি।
ফরহাদ শান্ত গলায় বলল, খবর পাঠাতে হবে না। আসলে আমি মার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না। মার সঙ্গে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এম্নিতেই মনটা খারাপ, তাঁর সঙ্গে কথা বললে মন আরো খারাপ হয়। আমি যাই।
রানী বলল, আপনি একটু রসুন। এক মিনিট। আপনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। নিয়ে যান।
ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, আমার কি জিনিস?
রাণী নীচু গলায় বলল, আপনি আপনার স্ত্রীর জন্যে বিয়ের শাড়ি কিনেছিলেন। আসমানী রঙের শাড়ি।
ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, তোমার কাছে কি ভাবে গেল?
রাণী তার জবাব না দিয়ে চলে গেল। শাড়ির প্যাকেট হাতে ফিরে এসে বলল, আমি কিন্তু প্যাকেটটা খুলে ফেলেছিলাম। কিছু মনে করবেন না। প্যাকেটের ভেতর একটা চিঠি ছিল। চিঠিটা প্যাকেটে দিয়ে দিয়েছি।
ফরহাদ তাকিয়ে আছে। মেয়েটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন লাগছে। তার সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেয়েটার সঙ্গে আসমানীর চেহারার কোন মিল নেই। কিন্তু তারপরেও তাকে কেন জানি আসমানীর মত দেখাচ্ছে।
রাণী বলল, আমি শুনেছি উনি খুব অসুস্থ। আপনি আবার যখন তাঁকে দেখতে যাবেন তখন অবশ্যই শাড়ি এবং চিঠি নিয়ে যাবেন।
ও কারো সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছে না। আজ আমার সঙ্গে দেখা করে নি। সকালবেলা অনেকক্ষণ বসেছিলাম।
এখন শাড়ি নিয়ে আবার যান। সকালে হয়ত মন খুব খারাপ ছিল। মানুষের মন খুব বেশিক্ষণ খারাপ থাকে না।
আসমানীর সঙ্গে মিলটা কোথায় ফরহাদ বের করতে পারছে না। গলার স্বরও অন্যরকম কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আসমানী কথা বলছে।
ফরহাদ বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে গেল। রাণী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই বাড়ির বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়। মানুষটা কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দেখতে রাণীর কষ্ট হচ্ছে। সে কেন জানি চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মানুষটা যদি হঠাৎ কোন কারণে পেছনে ফিরে তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
রাণীর হাত কাঁপছে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। তার রীতিমত কান্না পাচ্ছে। তার কেন এই সমস্যা হল?
আশ্চর্য আসমানীকে মোটেই অসুস্থ দেখাচ্ছে না। সে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে। চুল ছাড়া। তার লম্বা চুল বিছানা স্পর্শ করেছে। আসমানীর পরণের শাড়ির রঙ উজ্জ্বল। সবুজ জমিনে লাল ফুলের কাজ। তার অসুস্থতার একমাত্র লক্ষণ তার পায়ের উপর শাদা রঙের চাদর এবং বিছানার পাশের টেবিল ভর্তি অষুধ।
ফরহাদ বসেছে আসমানীর খাটে। বৃষ্টির ভেতর এসেছে বলে আধ ভেজা। মনে হয় তার ঠাণ্ডা লেগেছে। সে কয়েকবার হাঁচি দিল। আসমানী হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতুক। মনে হচ্ছে এক্ষুণী সে মজার কিছু বলবে, কিন্তু আসমানী চুপ করেই আছে। কিছু বলছে না। ফরহাদ বলল, কেমন আছ?
আসমানী সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, সকালে তোমার সঙ্গে দেখা করিনি বলে রাগ করো না। হঠাৎ করে খুব মন খারাপ করেছিল। হঠাৎ মনে হল কি আশ্চর্য সবাই থাকবে শুধু আমি থাকব না। এটা কেমন কথা।
মন খারাপ ভাবটা কি এখন কমেছে?
না কমে নি। তবে তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি।
তোমাকে আজ অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
মনে না হলেও আমি ভয়াবহ অসুস্থ। আমার রোগটার নাম হচ্ছে ক্রনিক মাইলয়েড লিউকোমিয়া। এই রোগের তিনটা স্তর থাকে। আমি আছি দ্বিতীয় স্তরে।
ও।
আসমানী হাসি হাসি মুখে বলল, হাসপাতালে থাকার সময় অল্পবয়েসী একজন ডাক্তারের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন বললাম, অসুখটা কি আমি ভালমত জানতে চাই—তখন সে রাজ্যের লিটারেচর দিয়ে যেতে শুরু করল। এই রোগ বিষয়ে আমি এখন একজন বিশেষজ্ঞ। তুমি কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পার।