এখন কিনলে এরা মাছটা কেটে বেঁধে ফেলবে। বড় মাছ কেটে ফেললে তার আর সৌন্দর্য কি? জামাই দেখতে পাবে না। সে অফিসে। সে বাসায় ফিরে সন্ধ্যায়।
রাহেলা মাছের জন্যে এক হাজার টাকা দিলেন। গলা নামিয়ে বললেন, যদি কিছু বেশি লাগে তুই দিয়ে দিস।
ফরহাদের মন সামান্য খারাপ হয়েছে। তার মা জামাইয়ের বাড়িতে তার সম্মান নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কিছুই এখন আর তাঁর চোখে পড়ছে না। একবার অন্তত বলতে পারতেন, তোর কি হয়েছে বলত? তোর চোখের নিচে কালি কেন? কিংবা জিজ্ঞেস করতে পারতেন, আসমানী মেয়েটা কেমন আছে? ওকে একবার দেখতে যাব। তুই আমাকে নিয়ে যা তো। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানী সম্পর্কে কারোর কোন আগ্রহ নেই। তার বাবা এখন পর্যন্ত আসমানীর কথা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আসমানী যদি টবে লাগানো কোন জাপানী ফুলের গাছ হত, তার বাবা। নিশ্চয়ই প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন।
ফরহাদ ঘড়ি দেখল। দেড় ঘন্টার মত হয়েছে, সে বসে আছে। এদের সমস্যাটা কি? এরা তাকে বসিয়ে রেখেছে কেন?
আসমানীর মামা বসার ঘরে ঢুকলেন। ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। কামরুল ইসলাম সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সারারাত ঘুমাননি। চোখের নিচে কালি। ঠোট শুকিয়ে আছে। তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বাভাবিক। কেমন যেন কুঁজো হয়ে আছেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত লাগছে।
ফরহাদ কেমন আছ?
জি ভাল।
কামরুল ইসলাম সাহেব নিজে বসলেন না, ফরহাদকেও বসতে বললেন না। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ, সরি। চা দিয়েছে?
জি।
আসমানীর শরীরটা বেশ খারাপ করেছে। এত দ্রুত এতটা খারাপ করার কথা। আমার মনে হয় —মন বিকল হয়ে গেছে। মন বিকল হলে এ রকম হয়। ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড়ালে সাধারণ চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়…।
ফরহাদ বলল, মামা আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলি?
কামরুল ইসলাম সাহেব ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইখানেই সমস্যাটা হয়েছে। ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না। এতক্ষণ তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম। লাভ হয় নি।
ও কি বলছে?
তোমাকে তার অসুস্থ মুখ দেখাবে না। এইসব হাবিজাবি বলছে। যেহেতু সে চাচ্ছে না, আমার মনে হয় তোমার দেখা না করাই ভাল হবে। এম্নিতেই সে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে। সেই চাপটা আর বাড়ানো ঠিক হবে না।
আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যাও। দেশের বাইরে যাবার আগে সে যদি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আমি তোমাকে খবর দেব।
আমি কি বিকেলে একবার আসব?
আসতে পার। তবে আমার মনে হয় না সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আসমানী ভয়ংকর ধরনের জেদী মেয়ে। যা বলবে তাই।
এপার্টমেন্ট হাউসে লিফট আছে, ফরহাদ নামছে সিড়ি দিয়ে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে নেমেই যাচ্ছে নেমেই যাচ্ছে, সিড়ি শেষ হচ্ছে না। সিড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট, নামতে কষ্ট না, কিন্তু এখন নামতেও কষ্ট হচ্ছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। ইচ্ছে করছে রেলিং ধরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করতে। হঠাৎ করে খুব ঘুমও পাচ্ছে। মেসে ফিরে গিয়ে আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভাল হত। চিন্তা ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত ঘুম। কতদিন হয়ে গেল সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না। ঘুমিয়ে পড়তে পারলে দরদাম করে মাছ কেনার কথা ভাবতে হবে না। নান্টু ভাইয়ের কথা ভাবতে হবে না। চিলড্রেনস রাইমস, পার্ট টুর বইটা কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়েও ভাবতে হবে না। ফরহাদ প্রাইভেট টিউশ্যানী শুরু করেছে। তার ছাত্রর মা চিলড্রেনস রাইমস পার্ট টু বইটা না-কি কোন দোকানে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফরহাদের দায়িত্ব বইটার খোঁজ করা।
এক বিদেশী অষুধ কোম্পানী মেডিকেল রিপ্রেজনটেটিভ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সেখানে লেখা—বেতন ভাতা আকর্ষণীয়। ছবি এবং বায়োডাটাসহ যোগাযোগ করুন। ফরহাদের কাছে বায়োডাটা আছে। ছবি নেই। থ্রি আর সাইজের ছবি তুলতে হবে। হাসি হাসি মুখের ছবি। কাউকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারলে ভাল হত। কোন মন্ত্রী বা এ ধরনের ক্ষমতাবান কেউ। তবে মন্ত্রীর সুপারিশে কাজ হবে না, কারণ পাঁচ হাজার দরখাস্ত যদি পড়ে সেই পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার দরখাস্তে মন্ত্রীর সুপারিশ থাকবে। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা জুড়ালো সুপারিশ করতে খুব পছন্দ করেন। নতুন ধরনের কোন সুপারিশ যদি কেউ তার জন্যে করত। যেমন ধরা যাক—কবি শামসুর রাহমান সাহেব তার দরখাস্তের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে তাকে নিয়ে দুলাইনের কবিতা লিখে সুপারিশ করলেন–
এই ছেলেটা ভাল এবং সৎ
তার বিষয়ে ইহাই আমার চিন্তিত অভিমত।
—শামসুর রাহমান
বাহ্ কবিতাটা তো ভাল হয়েছে। ফরহাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে—আসমানীর বিষয়ে এখন আর কিছু ভাববে না। কিছু না।
দিনটা কেমন মেঘলা মেঘলা। এ রকম মেঘলা দিনে আসমানীকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেই আসমানী বার বার তাকাতো আকাশের দিকে এবং বলতো তোমার কি মনে হয় বৃষ্টি হবে?
ফরহাদ বেশির ভাগ সময়ই বলতো, জানি নাতো।
আমার খুব টেনশান লাগছে।
কেন?
আকাশে ঘন কাল করে মেঘ হলেই আমার টেনশান শুরু হয়। যদি বৃষ্টি না হয়, যদি বৃষ্টি না হয়।
টেনশানের কি আছে? সব মেঘে কি আর বৃষ্টি হয়?
হয় না বলেই তো টেনশান।
আসমানী আজ সঙ্গে থাকলে তার টেনশান হত। কারণ আকাশ দ্রুত কালো হচ্ছে। কালো মেঘ নিয়ে যে গানটা আছে সেটা যেন কি?