দরজা খুলে দিল শর্মিলা। নান্টু বলল, কেমন আছ?
শর্মিলা বলল, ভাল।
তার আজকের গলা অন্যদিনের মত বরফ শীতল না। মুখটাও মনে হচ্ছে হাসি হাসি। নান্টু বলল, সিগারেটের জন্যে ধন্যবাদ।
তুমি কি চা খাবে?
এক কাপ খেতে পারি। অর্ণব কোথায়? ওর জন্যে একটা প্লাস্টিকের মাকড়শা এনেছি।
অর্ণব স্কুলে চলে গেছে।
নান্টু সাহসে ভর করে বলে ফেলল—ওর সামারের ছুটি কবে? ওকে নিয়ে একটা প্ল্যান ছিল।
কি প্ল্যান?
নান্টু হড়বড় করে বলল, ঠিক ওকে নিয়ে প্ল্যান না। তোমাদের দুজনকে নিয়েই প্ল্যান। ভাবছিলাম এই ছুটিতে তোমাদের নিয়ে নেপাল ঘুরে আসব। হিমালয় কন্যা নেপাল। ঢাকা থেকে যে খরচে কক্সবাজারে যাওয়া যায়, সেই খরচে নেপাল ঘুরে আসা যায়। বিদেশ দেখা হল। দেশ বিদেশ ঘুরলে শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। নেপালের হোটেলে দুটা ঘর নিয়ে নিলাম। একটায় তোমরা মা-বেটা, একটায় আমি। ঘর পাশাপাশি নেয়ারও দরকার নেই। তোমরা থাকলে দোতলা বা তিনতলায়, আমি একতলায়।
নান্টু ভেবেছিল কথা শুনেই শর্মিলা রেগে যাবে। সে রাগল না। তবে মুখ সামান্য গম্ভীর করে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল চা নিয়ে। শুধু চা না। ফুট কেক আছে, রসোমালাই আছে। নান্টু এক পিস কেক হাতে নিল। মনের ভুলে কেক চায়ে ড়ুবিয়ে এক কামড় দিল। শর্মিলা দেখেও কিছু বলল না। অন্য সময় এমন একটা ব্যাপার দেখলে চোখ সরু করে তাকাতো।
তুমি তাহলে আমাদের নেপাল নিতে চাচ্ছ?
দেশের ভেতরে কোথাও যদি যেতে চাও—সেখানেও নিতে পারি। কোন সমস্যা নেই।
মনে হয় তোমার অনেক টাকা হয়েছে।
আরে না। চাকরিই নেই। টাকা পাব কোথায়? তবে ব্যবস্থা একটা হবেই। চাকরি বাকরি আর করব না বলে ঠিক করেছি। ব্যবসা করব। ফুড বিজনেস।
ফুড বিজনেস মানে?
বিরানীর দোকান দেব। বাবুর্চির সঙ্গে কথা হয়েছে। সকালে এক হাড়ি বিরানী হবে। বিকালে এক হাড়ি। মাস তিনেক বাবুর্চি রেখে রান্নার কৌশলটা শিখে ফেলব। তারপর বাবুর্চি বিদেয় করে নিজেরাই রাঁধব। বাবুর্চির খরচটা বেঁচে গেল। খুবই লাভের ব্যাপার।
তাই না-কি?
হাজির বিরিয়ানীতে বিরানী বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেল।
তোমার বিরিয়ানীর নাম কি হবে—পাজীর বিরিয়ানী?
নান্টু হা হা করে হেসে ফেলল। শর্মিলার রসিকতাটা তার খুব মনে ধরেছে। শর্মিলা যে তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে তার জন্যেও ভাল লাগছে। তার কোন ব্যাপারে শর্মিলা অনেক দিন এত আগ্রহ দেখায় নি। নান্টু চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, লাভটা কেমন হবে একটু বুঝিয়ে বলি——মিডিয়াম সাইজ একটা পাতিলে চাল ধরে বিশ কেজি। বেস্ট কোয়ালিটি বাসমতি চাল হল ত্রিশ টাকা কেজি। কাজেই চাল লাগছে ছয়শ টাকার। বিশ কেজি চালে লাগছে দশ কেজি মাংস। দশ কেজি খাসির মাংসের দাম পরে—কেজি একশ টাকা হিসেশে এক হাজার টাকা। হিসাবটা কি ফলো করছ?
চেষ্টা করছি।
ঘি মশলাপাতি এইসব ধর পনেরোশ টাকা। কাজেই টোটেল খরচ হচ্ছে তিন হাজার টাকা। ফুল প্লেট পঞ্চাশ টাকা করে বিক্রি করলে নেট পাব ছয় হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি পাতিলে লাভ থাকবে তিন হাজার টাকা। দুই পাতিলে ছয় হাজার টাকা। মাসে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। ইস্টাবলিশমেন্ট খরচ, বাবুর্চির বেতন, বয় বেয়ারা সব মিলিয়ে ধরলাম পঞ্চাশ হাজার টাকা তারপরেও মাসে নেট প্রফিট হবে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। ইনশাল্লাহ।
ভালতো। নান্টু আনন্দিত গলায় বলল, দোকানের নাম ঠিক করেছি অর্ণব বিরাণী হাউস।
আমার ছেলের নামে বিরানীর নাম দিতে হবে না। তোমার নামে নাম দাও। নান্টু ভাইয়ের ভাই বিরানী। মামা হালিম আছে। ভাই বিরানীও হবে।
নান্টু সামান্য দমে গেল। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা শর্মিলা ঠিক পছন্দ করছে না। তার চোখ সরু হয়ে গেছে। গলাও অনেক গম্ভীর শুনাচ্ছে।
শর্মিলা শীতল গলায় বলল, বাবুর্চির খরচওতো তোমার লাগবে না। তুমিতো কয়েকমাস পরে নিজেই রাঁধবে। এটা মন্দ না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে অর্ণবের বাবা কি করেন? আমরা বলব, বাবুর্চি। আমাদের কোন খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজন হলে তোমাকে বাবুর্চি হিসেবে ভাড়া করে নিয়ে আসব। তোমরা নিশ্চয়ই বাইরের রান্নার কাজও করবে, করবে না?
নান্টু অস্ট্রেলিয়ান সিগারেট ধরাল। ব্ৰিত গলায় বলল, তোমার পছন্দ না হলে বিরানী হাউসের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেব।
শর্মিলা কঠিন গলায় বলল, আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে দরকার কি? আমিতো তোমার কেউ না। তোমার যা ইচ্ছা তুমি করবে। তুমি বাবুর্চি হলেও কিছু না। জুতা পালিশওয়ালা হলেও কিছু না।
নান্টু অনেক কষ্টে বলল, ও আচ্ছা।
শর্মিলা বলল, তোমাকে কি জন্যে ডেকেছি এখন শোন। তোমাকেতো বলে বলে আমি হয়রান হয়েছি। ইচ্ছা করেই তুমি গা করছ না। আজ আমি ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব। রাজশাহী থেকে আমার বড় ভাই এসেছেন। উনি সব ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের কোথাও যেতে হবে না। কিছু না। কাগজপত্র নিয়ে এখানে লোকজন আসবে। তুমি আমি একসঙ্গে সাইন করব।
নান্টু পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। আজকের দিনে এমন কোন ঘটনা ঘটাবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। নান্টু প্রায় ফিস ফিস করে বলল, তুমি কি বিয়ে করছ নাকি?
শর্মিলা সহজ ভাবে বলল, হ্যাঁ করছি।
তোমাদের বিয়ের পর অর্ণব কি আমার সঙ্গে থাকবে?
শর্মিলা বিরক্ত গলায় বলল, উদ্ভট কথা বলবে না। অর্ণব তোমার সঙ্গে মেসে গিয়ে উঠবে? অবসর সময়ে বিরানী হাউসের কাস্টমারদের বিরানী খাওয়াবে? প্লেট ধুয়ে দেবে। তুমি সারা জীবনে নানান ধরনের যন্ত্রণা করেছ। আর যন্ত্রণা করবে না। আরাম করে বোস। চা খেতে চাইলে বল আবার চা দিচ্ছি।