আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তোর কি পছন্দের কেউ আছে? চোখ মোছ। চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় কথা বল। আছে কেউ?
রাণী বলল, না।
এমন কোন ছেলে কি আছে যার সঙ্গে ভাব হয়েছে? টেলিফোনে কথা হয় বা চিঠি চালাচালি হয়?
না।
তাহলে এখানে বিয়ে হতে অসুবিধে কি? ছেলে দেখতে সুন্দর। ডাক্তার। টাকা পয়সা আছে। ফ্যামিলি ভাল।
রাণী চুপ করে রইল। আসগর সাহেব বললেন, পছন্দের কেউ না থাকলে যেখানে বিয়ে ঠিক করেছি সেখানেই বিয়ে হবে। চোখের পানি ফেলে লাভ হবে না। চোখের পানির দাম দশ নয়া পয়সা।
রাণী আবার ফুঁপাতে শুরু করল। ফুঁপানির মধ্যেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তার খুব পছন্দের একজন মানুষ আছে। মানুষটা হল জাহানারা ভাবীর ভাই। ফরহাদ ভাই।
আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তার সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?
রাণী বলল, না।
টেলিফোনে কথা হয়?
কখনো কথা হয় নি।
চিঠি লেখালেখি?
না।
ফরহাদ সাহেব কি তোর পছন্দের ব্যাপার জানেন?
না।
সত্যি কথা বল।
সত্যি কথাই বলছি। উনি কিছুই জানেন না।
কথাবার্তা চলাকালিন সময়ে রাণী এক মুহূর্তের জন্যেও ফুঁপানি বন্ধ করল না। শাড়ির অর্ধেকটা সে চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলল। আসগর সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, কান্না বন্ধ কর। আমি ব্যবস্থা করছি। তবে কেউ যেন জানতে না পারে যে ছেলে তোর নিজের পছন্দ। যদি জানে আমি টান দিয়ে তোর জিব ছিঁড়ে ফেলব। নিজেই ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেব। আমি বলব, ছেলে আমাদের নিজেদের পছন্দ। পারিবারিক ভাবে পছন্দ। এখন তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না।
রাণীর বড় ভাই তার কথা রেখেছিলেন। তাদের হিসাব মতে অতি অপদার্থ একজন ছেলের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টায় কোন লাভ যে হয় নি তা না। একটা লাভ হয়েছে—রাণীর ভয়ংকর এক অসুখ হয়েছে। অসুখের লক্ষণ হল তাকে হঠাৎ হঠাৎ বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা করে। অতি সামান্য একটা ব্যাপার থেকে এত বড় অসুখ কেন হল সে জানে না। কোনদিন হয়ত জানবেও না।
রাণী গল্পের বইটা খুলল। বইয়ের ভেতর থেকে চিঠিটা আবার বের হয়ে এসেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে—এমন একটা চিঠি যদি তার কাছে লেখা হত। কিংবা এমন যদি হত সে রাণী না, তার নাম আসমানী…
রাণীর চোখ ভিজে উঠছে। কিছুক্ষণ আগেই সে অনেক হাসাহাসি করেছে এখন চোখে পানি আসবেই। কিচ্ছু করার নেই।
নান্টুর মন আজ অত্যন্ত ভাল
নান্টুর মন আজ অত্যন্ত ভাল।
গত রাতে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হয়েছে তার জীবনে ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে উল্টোটা ঘটবে। স্বপ্নের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে যা দেখা যায় তার উল্টোটা হয়। যদি কেউ দেখে সে মারা যাচ্ছে তাহলে তার হায়াত বাড়ে। নান্টু স্বপ্নের মধ্যে দেখেছে একটা ন্যাংটা পাগল তাকে তাড়া করেছে। পাগলের হাতে বর্শা। সে কিছুক্ষণ পর পর বর্শা ছুঁড়ে মারছে। বর্শা নান্টুর গায়ে লাগছে না। ঘটনাটা বাস্তব হলে বর্শা ছুঁড়ে মারার পর পাগলের হাতে আর বর্শা থাকত না। স্বপ্নের ঘটনা বলেই বর্শার কোন অভাব হচ্ছে না।
স্বপ্নের কারণেই সকালে চা খাবার সময় তার মনটা খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু নটার দিকে তার মন অসম্ভব ভাল হয়ে গেল। শর্মিলা তাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। সম্বােধনহীন চিঠি হলেও চিঠি পড়ে বোঝা যায় শর্মিলার মন গলেছে।
আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন। তিনি যে সব গিফট নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে আছে এক কার্টুন অস্ট্রেলিয়ান সিগারেট। এ বাড়িতে সিগারেট খাবার লোক নেই বলে তোমাকে পাঠালাম।
ভাল কথা, তুমি কি আজ দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে একটু আসতে পারবে। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে।
ইতি—
শর্মিলা।
ক্যাঙ্গারুর দেশের সিগারেট বলেই হয়তো প্যাকেটে রূপালী রঙের ক্যাঙ্গারু। এমন অসাধারণ ঘটনা ঘটল অথচ ফরহাদকে দেখানো গেল না। সে সূর্য উঠা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যায়। ফিরে রাত দশটার পর। মেসে এসে গোসল করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কোন কথা নেই, কিছু নেই। মানুষ না যেন রোবট। যে রোবটের একটাই কাজ সকালবেলা বের হয়ে যাওয়া গভীর রাতে ফেরা। নান্টু। ধারণা সে রাতে ঘুমায়ও না। মাঝে মধ্যে নান্টু ঘুম ভেঙ্গে দেখেছে ফরহাদ চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে সিগারেটের আগুন উঠা নামা করছে।
ফরহাদ থাকলে তাকে দু প্যাকেট সিগারেট দেয়া যেত।
নান্টু দশটার অনেক আগে বের হল। শহরে ট্রাফিক জ্যাম যে ভাবে বেড়েছে কোথাও যেতে হলে এক দু ঘন্টা আগে বের হতে হয়। তাছাড়া তাকে রসোমালাই কিনতে হবে। যে দোকানে ফ্রেশ রসোমালাই পাওয়া যায় সেটা আবার উল্টো দিকে। অর্ণবের জন্যেও কিছু একটা নিতে হবে। বাবাকে দেখলেই সে প্রথমে বাবার মুখের দিকে তাকায় না, তাকায় বাবার হাতের দিকে। চট করে দেখে নেয় হাতে উপহারের কোন প্যাকেট আছে কি-না। খেলনার দোকানে পোকা মাকড় জাতীয় কোন খেলনা খোঁজ করতে হবে। বাচ্চাদের অদ্ভুত সাইকোলজি। যে সব জিনিশ তারা সবচে ভয় পায় তার খেলনা আবার তাদের জানের জান। অর্ণব সবচে ভয় পায় সাপ। অথচ রাবারের সাপ তার সবচে পছন্দের। গত জন্মদিনে তাকে একটা রাবারের সাপ দেয়া হয়েছিল সেই সাপের লেজ ধরে না থাকলে তার রাতে ঘুম হয় না। সাপ খোপ পাওয়া গেলে কিনতে হবে।