রাণী ছুটে এসে ফরহাদকে বলল, আপনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন। আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।
ততক্ষণে উল্টো দিক থেকে আর একটা মিছিল আসতে শুরু করেছে। সেই মিছিলে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা আসছে ধীরে ধীরে তবে এই মিছিল মনে হচ্ছে আগেরটার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এদের কয়েক জনের হাতে খোলা বন্দুক। দিনের বেলায়ও হাতে মশাল।
ফরহাদ রাণীকে বলল, চলুন কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়ি।
রাণী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলুন। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার শরীর শক্ত হয়ে গেছে।
ফরহাদ তাকে নিয়ে প্রথমে একটা গলিতে ঢুকল। সেখান থেকে অন্য একটা গলি দিয়ে বড় রাস্তায়। সেই রাস্তায় কোন গন্ডগোল নেই, সব স্বাভাবিক। দোকান পাট খোলা। একটা দোকানে আবার হিন্দী গানও হচ্ছে। রিক্সা চলছে। ফরহাদ বলল, আপনার ভয় কি একটু কমেছে?
রাণী বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। ফরহাদ ভাই আসলে তাকে এতক্ষণ চিনতে পারেন নি। তাকে অন্য কোন মেয়ে ভাবছেন বলেই আপনি আপনি করে বলছেন। ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে তার খুব বেশি দেখা হয় নি তার পরেও চিনতে না পারার তো কথা না। রাণী শাড়ি পরেছে বলে কি তাকে অন্য রকম লাগছে?
ফরহাদ বলল, আপনাকে এখন একটা রিক্সা করে দিলে আপনি বাসায় যেতে পারবেন না?
রাণী বলল, পারব না। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। তার আগে আমি এক গ্লাস পানি খাব।
ফরহাদ বলল, আপনার বাসা কোন দিকে?
এই প্রশ্নে রাণী পুরোপুরি নিশ্চিত হল ফরহাদ ভাই তাকে মোটেই চিনতে পারেন নি। ব্যাপারটা খুবই মজার। এত পরিচিত একজন মানুষ তাকে চিনতে পারছে না। আশ্চর্যতো!
রাণী বলল, খালি পায়ে আমি বাসায় যেতেও পারব না। আমাকে আপনি দয়া করে কোন একটা জুতার দোকানে নিয়ে যান। আমি একজোড়া স্যান্ডেল কিনব।
আগের স্যান্ডেল কোথায়?
কে জানে কোথায়। আমি স্যান্ডেল ফেলেই দৌড় দিয়েছি।
আপনার ভয় কি কমেছে?
সামান্য কমেছে। পুরোপুরি কমেনি। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব আর স্যান্ডেল কিনব।
স্যান্ডেল না কিনলে হয় না? যে কোন সময় গন্ডগোল শুরু হবে।
শুরু হলেও এখন আমার ভয় লাগবে না। আপনার কি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে কোন আপত্তি আছে?
একটা রিক্সা নিন, আমি খালি পায়ে হাঁটতে পারছি না। এখন পানি না খেলেও হবে। আমার পিপাসা মরে গেছে।
ফরহাদকে দেখে মনে হল সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। রিক্সায় বসেছে খুব। সাবধানে যেন কিছুতেই গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। কেমন ব্ৰিত ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাচ্ছে। মানুষটা মনে হয় কখনো কোন তরুণী মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠে নি।
রাস্তায় আইসক্রীমওয়ালার এক ভ্যান গাড়ি দেখা গেল। রাণীকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদ বলল, আইসক্রীম খাবেন?
রাণী আইসক্রীম কখনো খায় না। প্রথমত আইসক্রীম খেতে তার ভাল লাগে না। দ্বিতীয়ত তার টনসিলের সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই তার গলা ফুলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে। তারপরেও সে স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ আইসক্রীম 3791
রাণী সেদিন বেশ কিছু কাণ্ড করল যেমন, স্যান্ডেল কেনার পর তার মনে হল, তার লেখার বল পয়েন্ট নেই। বল পয়েন্ট কিনতে হবে। সে ফরহাদকে নিয়ে বল পয়েন্ট কিনতে গেল। তারপর মনে হল রীতার জন্যে গিফট কেনা হয় নি। গিফট এবং ফুলের তোড়া কিনতে হবে। সে ফরহাদকে সঙ্গে নিয়ে গিফট কিনল। তারপর ফরহাদকে বলল তাকে রীতার বাসায় পৌঁছে দিতে।
রীতাদের বাসায় যাবার সারা পথটা রাণী গল্প করল। নানান গল্প–
আমি এখন যেখানে যাচ্ছি সেটা আমার বাসা না। আমার বন্ধুর বাসা। ওরা নাম রীতা। আজ রীতার জন্মদিন। রীতাদের বাসা থেকে আমি বড় ভাইজানকে টেলিফোন করব। তিনি গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবেন। রীতার বাবাকে আমরা কি ডাকি জানেন? আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। কেন ডাকি জানেন? কারণ রীতারা এগারো ভাই বোন। এই সময়ে কোন ভদ্রলোকের এগারো ছেলে-মেয়ের কথা কখনো শুনেছেন? রীতার বাবার দলে এগারো জন প্লেয়ার আছে বলেই ওনাকে আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। নামটা ভাল হয়েছে না?
হুঁ।
আচ্ছা শুনুন। আপনিও চলুন না রীতাদের বাসায়?
আমি আমি কেন?
ওদের বাড়িতে অনেক মজা হবে। গানের আসর হবে। সেলিম চৌধুরী নামে একজন গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। উনি হাসন রাজার গান শুনাবেন। আপনি কি হাসন রাজার গান শুনেছেন।
একটা দুটা শুনেছি।
হাসন রাজার আসল নাম কিন্তু হাসন রেজা। রেজা নাম তার পছন্দ হল না। তিনি সবাইকে বলে দিলেন—আমাকে এখন থেকে কেউ রেজা ডাকবে না। আমাকে ডাকতে হবে রাজা। সেই থেকে তিনি রাজা।
ও।
রীতাদের বাসার সামনে বেবীটেক্সি থেকে নামার সময় একবার রাণীর ইচ্ছা হল নিজের পরিচয় দিতে। তারপরেই মনে হল —থাক কি দরকার। কোন এক সময় মানুষটাকে এই ঘটনা বলে চমকে দেয়া যাবে।
তার পরপরই রাণীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তার বড় ভাই আসগর সাহেব বোনের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে ফেলেন। ছেলে ডাক্তার। ছেলের বাবা বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসা সূত্রে ছেলের বাবার সঙ্গে আসগর সাহেবের পরিচয়।
ছেলে তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তাদের পছন্দ। যেদিন বিয়ের তারিখ ঠিক হবে সেদিন রাণী অসীম সাহসের পরিচয় দিল। একা একা তার বড় ভাইয়ের অফিসে উপস্থিত হল। আসগর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার তুই এখানে কেন?
রাণী ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তার এই বিয়েতে মত নেই। এখানে বিয়ের তারিখ হলে সে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যাবে।