রাণী হাসতে হাসতে বলল, নাম লেখা ছিল না। তবে একটা চিঠি ছিল। আবেগপূর্ণ চিঠিটা পড়বে?
জাহানারা তাকিয়ে আছে। রাণী বলল, ভাবী তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি—তোমার ভাইয়াকে আমার খুবই অপছন্দ। তোমরা যখন তার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করলে তখনই রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। যেহেতু আমি খুবই শান্ত এবং টাইপ মেয়ে সেহেতু চুপ করে ছিলাম। মনে মনে ভেবেছি–কি আর করা। কপালে যা আছে হবে। সেই ব্যাপার তোমরা আবার শুরু করেছ। এখন আর রাগ লাগছে না। এখন মজা লাগছে।
জাহানারা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে এই নিয়ে পরে কথা হবে।
ভিটামিন ট্যাবলেট দেব ভাবী?।
জাহানারা গম্ভীর মুখে চলে গেল। রাণী ঠোটের লিপস্টিক মুছল। হাত মুখ ধুয়ে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় চলে গেল। গল্পের বইয়ের ভেতরে ফরহাদ ভাইয়ের চিঠিটা আছে। গল্পের বই পড়া শুরু করার আগে চিঠিটা কি আরেকবার পড়বে? চিঠিতে এমন কিছু নেই কিন্তু পড়তে গেলে হঠাৎ করে কেন জানি মন খারাপ হয়–
আসমানী,
তোমাকে বিয়ের শাড়ি হিসেবে খুব সস্তা ধরনের শাড়ি দিচ্ছি। সস্তা শাড়ি কেনার একমাত্র কারণ অর্থনৈতিক। আমার ভয়ংকর দরিদ্র অবস্থা দেখে তুমি যে কত বড় ধাক্কা খাবে সেটা ভেবে খুব আতংকগ্রস্ত।
শাড়িটা সস্তা হলেও রঙটা খুব সুন্দর। তুমি হচ্ছ আসমানী। আমি অনেক খুঁজে খুঁজে আসমানী রঙের শাড়িটা বের করলাম। শাড়িটা যখন পড়বে তখন মনে হবে এক টুকরা আকাশ পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আসমানী এখন বলতো একটা গাছে দশটা পাখি ছয়টা উড়ে গেল কটা থাকল?
রাণী চিঠি বইয়ের ভেতর রেখে চিঠির ধাঁধার রহস্য বের করার চেষ্টা করতে লাগল। এই ধাঁধার অর্থ কি? এটা ধাঁধা না কোড ল্যাংগুয়েজ? খুব ইচ্ছা করছে ফরহাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে। সেটা সম্ভব না।
রাণীর মন খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। তার ভয় লাগছে। একবার তার মন খারাপ হওয়া শুরু করলে দ্রুত মন খারাপ হতে থাকে। এবং এক সময় এত বেশি মন খারাপ হয় যে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাটা এত প্রবল যে ইচ্ছাটা চলে যাবার পরেও তার হাত পা কাঁপতে থাকে। শরীর ঘামতে থাকে। সে জানে এটা ভয়ংকর কোন অসুখ। এই অসুখ থেকে তার মুক্তি নেই।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। ফরহাদ নামের একজন মানুষ তার ভেতরে এই অসুখটা তৈরী করে দিয়েছে। যে অসুখটা তৈরী করেছে সে কিন্তু কিছুই জানে না। তার জানার কোন কারণও নেই। এবং সে কোনদিনও জানবে না। কোন একদিন হয়ত সে খবর পাবে রাণী নামের একটা মেয়ে বাথরুমে মারা গেছে। বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ডেড বডি বের করতে হয়েছে। মানুষটা হয়ত সৌজন্যবশত মরা বাড়িতে আসবে। দুএকটা সান্তনার কথা বলবে হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। সব মানুষকে একদিন মরতে হবে ইত্যাদি। মানুষটা জানবেও না রাণী নামের এত ভাল একটা মেয়ে কেন শুধু শুধু মরে গেল? কারণ সে কোন চিঠিপত্র লিখে যাবে না।
তবে চিঠি লিখতে পারলে সে খুব গুছিয়ে লিখে বলতে পারত কি করে ফরহাদ নামের খুবই সাধারণ একজন মানুষ তার ভেতরে এত বড় সমস্যার সৃষ্টি করল। চিঠিটা সে ফরহাদকেই লিখত। সুন্দর খামে ভরে রাখত। বাসর রাতে মিষ্টি মিষ্টি কথা না বলে গম্ভীর মুখে বরের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়া। বিয়েই হচ্ছে না। কিসের বাসর, কিসের চিঠি। ঘটনাটা এরকম—
রাণী যথারীতি কলেজে গিয়েছে। গাড়ি তাকে কলেজ গেটে নামিয়ে চলে গেছে। অন্য দিনের চেয়ে আজ তার সাজগোজ সামান্য বেশি। শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল আপা বলে দিয়েছেন কলেজের মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দিতে পারবে না। তারপরেও সে হালকা করে লিপস্টিক দিয়েছে। কারণ আজ তার অতিপ্রিয় বান্ধবী রীতার জন্মদিন। ক্লাসের শেষে তারা দলবেধে গুলশানে যাবে। গুলশানে একটা দোকানে সাউদার্ন ফ্রায়েড চিকেন খাওয়া হবে। তারপর রীতার বাসায় যাওয়া হবে। সেখানেও অনেক হৈ চৈ এর ব্যবস্থা। সেলিম চৌধুরী নামের এক গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি হাসন রাজার গান করবেন।
রাণী কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখে গেট বন্ধ। দারোয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, আপা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। শহরের অবস্থা ভাল না। গন্ডগোল হবে। বিরাট গন্ডগোল।
কিসের গন্ডগোল?
কিসের গন্ডগোল বলতে পারব না। বাসায় চলে যান।
রাণী কি করবে বুঝতে পারছে না। রীতার জন্যে কি অপেক্ষা করবে? ক্লাসের মেয়েরাও অবশ্যই আসবে। গন্ডগোলের কথা তারা নিশ্চয় জানে না, কলেজে এসে জানবে। রাণী আবারো গেটের কাছে ফিরে গেল। দারোয়ানকে বললে সে যদি ছোট গেটটা খুলে দেয়। তাহলে সে কলেজ কম্পাউন্ডের ভেতরে অপেক্ষা করতে পারবে। প্রিন্সিপাল আপার অফিস থেকে টেলিফোন করা যেতে পারে। বড় ভাইজানের অফিসে টেলিফোন করলে তিনি গাড়ি পাঠিয়ে দিবেন।
গেট পর্যন্ত যাবার আগেই হঠাৎ করে ভয়াবহ ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। নিউ মার্কেটের দিক থেকে চোখের নিমিষে একটা জঙ্গী মিছিল চলে এল। বিকট শব্দে কয়েকটা বোমা পড়ল। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা-ভাঙ্গি শুরু হয়ে গেল। মিছিলের লোকজনের হাতে বড় বড় বাঁশ। অনেকের হাতে কেরোসিনের টিন। গাড়ি ভেঙ্গে গাড়িতে আগুন দেবার ব্যবস্থা। বাঁশ হাতে লোকগুলি এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে যেন এরা মানুষ না। অতি হিংস্র ভয়ংকর কোন প্রাণী।
লোকজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। একটা লোক বাশ হাতে রাণীর দিকে আসছে। রাণীর মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আর তখনি সে দেখে ফরহাদকে। অবাক হয়ে ফরহাদ ভাই জঙ্গী মিছিল দেখছেন। অবাক হয়ে দেখার মতই দৃশ্য। একটা বাস পুড়ছে। বাস ভর্তি লোকজন। বাস থেকে তারা লাফিয়ে নামার চেষ্টা করছে।