রাহেলা বেগম দৈ-এর বাটি হাতে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন তার মেজাজ সামান্য খরাপ। তার মন বলছে—তাঁকে দেখেই ছেলে যে কথাটি বলবে তা তিনি জানেন। জানেন বলে এই মুহূর্তে তাঁর মন একটু খারাপ। ছেলের কথার জবাবে কঠিন কিছু কথা অনেকদিন থেকেই তিনি বলবেন বলবেন করছেন। বলা হয় নি। আজ হয়ত বলে ফেলবেন। রোজগারী ছেলেকে কঠিন কথা বলা যায় না। এতে সংসারের অকল্যাণ হয়। তবু বলবেন। সংসার ঠিক রাখার জন্যেও মাঝে মাঝে দুএকটা কঠিন কথা বলা দরকার। কঠিন কথা পেরেকের মত। সংসার নড়বড়ে হলে কঠিন কথার পেরেক লাগে।
রাহেলা জানেন তাকে দেখে ফরহাদ প্রথম যে কথাটা বলবে তা হচ্ছে—দাদাজানকে রাত্রে খেতে দিয়েছ? এটা কেমন কথা তিনি বুড়োকে খেতে দেবেন না কেন? দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর যে সেবাটা করা হচ্ছে সেটা কেন তার ছেলের চোখে পড়ে না। বুড়ো আজকাল প্রায়ই বিছানা নষ্ট করে। কে সে সব পরিষ্কার করে? কাজের মেয়েরা এইসব কখনো করবে না। এইসব তাকেই করতে হয়। শ্বশুরের যত্ন এক কথা—তার নোংরা পরিষ্কার করা ভিন্ন কথা। বুড়োর নিজের ছেট মেয়ে এই শহরেই বাস করে। বুড়ো তার সঙ্গে গিয়ে থাকলেই পারে। শেষ বয়সে বুড়ো বাপের যত্ন মেয়েরা করবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলে যদি মনে করে তার দাদাজানের যত্ন এই বড়িতে হচ্ছে না তাহলে সে বুড়োকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেই পারে। রাহেলা মনস্থির করলেন আজ যদি ফরহাদ তার দাদাজান বিষয়ে কিছু বলে তাহলে তিনি অবশ্যই বলবেন—ফরহাদ যেন তার দাদাজানকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
ফরহাদ মাকে দেখেই বলল, রাতে দাদাজানকে খেতে দিয়েছ?
রাহেলা বললেন, না। উপাস রেখে দিয়েছি।
ফরহাদ চোখ ছোট ছোট করে মার দিকে তাকাল। রাহেলা বললো, উনার পেট খারাপ করেছে। পেটে কিছুই সহ্য হচ্ছে না। এই জন্যে চিড়ার পানি দিয়েছি।
শুধু চিড়া-পানি?
লেবু দিয়া চিড়া-পানি পেটের জন্যে ভাল।
রাহেলা ছেলের খাটের এক পাশে বসতে বসতে বললেন–তোর দাদার নোংরা বিছানা চাদর পরিষ্কার কর এক সমস্যা হয়েছে। কাজের মেয়ে করতে চায় না। এই বয়সে আমিও পারি না।
ফরহাদ বলল, আমাকে দিও। আমি ধুয়ে দেব।
পাগলের মত কথা বলিসনাতো। তুই ধুবি কি?
কোন সমস্যা নেই।
তুই উনাকে কিছুদিন যাত্রাবাড়িতে রেখে আয়। কিছুদিন মেয়ের সেবা নিক। বুড়ো বাবা মার সেবা করাওতো মেয়েদের ব্যাপার। তোর ফুপু কিছু সোয়াব পাক।
ফরহাদ কিছু বলল না। রাহেলা বললেন–জানুর ছোট মেয়েটার পরশু আকিকা। সবাইকে যেতে বলেছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। সোনার আংটি হলেও নেয়া দরকার। আমার অবশ্য একটা সোনার চেইন দেয়ার শখ। মেয়ের ঘরের নাতী। একটা চেইন কেনার টাকা দিতে পারবি?
ফরহাদ বলল, না।
রাহেলা ক্লান্ত গলায় বললেন, একটা সামাজিকতার ব্যাপার আছে। সবাই জানতে চাইবে মেয়ের নানী কি দিল?
ফরহাদ বলল, যে যার সামর্থ অনুসারে দিবে। পরে ফকিরতো আর কোহিনুর ইরা দিবে না।
রাহেলা বললেন, তুই পথের ফকির না। আর আমিও কোহিনুর হীরা দিতে »াই না। সামান্য একটা চেইন। হাজার পনেরোশ টাকা দাম।
ফরহাদ বলল, মা শুয়ে পড় আমার ঘুম পাচ্ছে। দৈ-এর বাটি নিয়ে যাও। দৈ খাব না।
তুইতো আজ কিছুই খাস নাই—শরীর খারাপ?
শরীর ঠিক আছে। মাছের মাথাটা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছিল তাতেই ক্ষিধে মরে গেছে।
রাহেলা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরহাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার কোন চিঠিপত্র এসেছে?
এসেছে। তোর ড্রয়ারে রেখেছি।
ড্রয়ারে কেন রাখবে। কতবার বলেছি চিঠি পত্র সব টেবিলের উপর পেপার ওয়েট দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখবে। ঢাকায় ফিরেই যেন চিঠিগুলি চোখে পড়ে।
পান খাবি? পান দেব?
না।
তুই হঠাৎ এমন মেজাজ খারাপ করছিস কেন?
মেজাজ খারাপ করছি না মা? যাও ঘুমুতে যাও।
মাথায় একটু নারিকেল তেল ডলে দেই। অনেক দিন মাথায় তেল না দিলে–অল্পতে মাথা গরম হয়। চুল পড়ে যায়। তোর মাথার চুল কমে যাচ্ছে।
কমুক।
চা খাবি?
আচ্ছা যাও মা। চা নিয়ে আস। চা পান সব আন।
রাহেলা চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বের হলেন। ফরহাদ ড্রয়ার খুলে চিঠি বের। করল। সে যা ভেবেছিল তাই—আসমানীর চিঠি। যতবারই সে ঢাকার বাইরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছে ফিরে এসে আসমানীর চিঠি পেয়েছে। এবার দিন মাত্র তিন দিন এর মধ্যেই চিঠি পাবার কথা না। কিন্তু ফরহাদের মন বলছিল চিঠি পাবে।
আসমানীর হাতের লেখা সুন্দর। সে চিঠিও খুব গুছিয়ে লেখে। একটা শুধু সমস্যা চিঠি হয় ছোট। হাতে নিতে না নিতেই শেষ। আসমানী লিখেছে—
এই যে
বাবু সাহেব,
আপনি তাহলে ঢাকায় ফিরেছেন? আপনার জন্যে খুবই দুঃসংবাদ। জাপান থেকে আমার মামা এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছেন। এবং আমার মাকে বলেছেন-পাত্র যদি ঠিক থাকে এই শুক্রবার আসমানীর বিয়ে দিয়ে দাও। হুলস্থুল করার কোন দরকার নেই। একজন কাজী ডেকে এনে বিয়ে। পরের দিন কোন ভাল রেস্টুরেন্টে একটা রিসিপশান। রিসিপশনের খরচ আমি দেব। মা মনে হয় রাজি। কাজেই এই শুক্রবারে তোমার বিয়ে। বাবু সাহেব এখন তোমাকে খুবই জরুরী কথা বলছি—তুমি যখনই চিঠিটা পাবে তখনি আমাদের বাসায় চলে আসবে। রাত তিনটার সময় হলে তিনটায় আসবে। কারণ তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে।
আচ্ছা শুনতে আমার সোনার বাংলার পরের লাইনটা যেন কি?
তোমার
আ
পুনশ্চঃ আমার সোনার বাংলার পরের লাইন হচ্ছে—