কি আশ্চর্য মেয়েটা সত্যি সত্যি আসছে। ফরহাদ দৈয়ের হাড়ি মাটিতে নামিয়ে সিগারেট ধরাল। যারা ধুমপান করে না তারা জানে না ধুমপায়ীদের কাছে সিগারেট শুধুমাত্র নেশা না এক ধরনের আশ্রয়ও। সে এখন সিগারেটের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। মেয়েটাকে কি বলা যায়? তাকে বলা যেতে পারে—নিশিকন্যা শুনুন। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি সেই টাইপের ছেলে না। আমি একজন স্কুল শিক্ষকের জ্যৈষ্ঠ সন্তান। M.Sc পাশ করে বর্তমানে অষুধ কোম্পানীতে ছোট একটা চাকরি করছি। যে চাকরি করছি সেখানে দুনম্বরীর অনেক সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত তার ধারে কাছে যাই নি। কোনদিন যাব তা মনে হয় না। আমি নিতান্তই ভাল মানুষ টাইপের একজন। আমার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটির নাম আসমানী। আমি তাকে ঠাট্টা করে ডাকি মিস স্কাই। যে কোন দিন তার সঙ্গে আমার হুট করে বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিয়েটা আসলে আটকে আছে মিস স্কাই-এর মামার জন্যে। তিনি থাকেন জাপানে। কিছু কিছু ভাগ্যবান মানুষ আছেন সূত্রধর টাইপ। দূর থেকে সূতা ধরে পুতুল চালান। আসমানীর এই মামা হচ্ছেন সূত্রধর মামা। তিনি জাপানে বসে আসমানীদের পরিবারের সুতা ধরে থাকেন। এই সূত্রধর মামা তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে ফিরবেন। তখন আসমানী মামাকে সব বলবে। আসমানীর ধারণা মামা তখন বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। কাজেই ম্যাডাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কাছে আসা অর্থহীন। আপনার জন্যে পেট্রল পাম্পে গাড়িওয়ালা কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা করাই ভাল হবে।
মেয়েটি ফরহাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা খালি বেবীটেক্সী সামনে দাঁড়াল। দরদাম করার সময় নেই। ফরহাদ বেবীটেক্সীতে উঠে পড়ল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদের চট করে বেবীটেক্সীতে উঠা দেখে সে মনে হয় বেশ অবাক হয়েছে। কাছে থেকেও মেয়েটার চেহারা খারাপ লাগছে না। বৃষ্টির জন্যে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়েছে। মেয়েটার মধ্যে বউ বউ ভাব চলে এসেছে। মিষ্টি নরম চেহারা। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানীর সঙ্গে মেয়েটার চেহারায় কোথায় যেন একটু মিল আছে। ফরহাদ লজ্জিত বোধ করল—এমন বাজে টাইপের মেয়ের সঙ্গে আসমানীর চেহারার মিল থাকবে কেন?
বেবীটেক্সীওয়ালা টেক্সী স্টার্ট দিয়েছে। ফরহাদ বলল, কলাবাগান চল। বেবীটেক্সীওয়ালা মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, একা যাইবেন?
ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ একা। বৃষ্টি আবারো জোরে নেমেছে। মেয়েটার উচিত দৌড়ে পেট্রল পাম্পে চলে যাওয়া। সে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তার চোখে অবাক ভাবটা এখন আর নেই। দৈ-এর হাড়িটা মেয়েটাকে দিয়ে দিলে ভাল হত। এদেরতো কেউ কখনো কোন উপহার দেয় না। সে না হয় দিল এক হাড়ি দৈ। হাড়িটা দিয়ে সে বলতে পারত–বাড়িতে নিয়ে আরাম করে খাও। বগুড়ার মিষ্টি দৈ। ফ্রেশ দৈ। আজই কেনা হয়েছে। ফরহাদ কি বলবে বেবীটেক্সীওয়ালাকে—বেবীটেক্সী ঘুরাতে। অনেক দূর চলে এসেছে। এখন বলাটা ভাল হবে না। বেবীটেক্সীওয়ালা নানান কিছু ভাবতে পারে। ফরহাদের মন খারাপ লাগছে।
ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে আজকাল টিউবওয়েল দেখা যায় না। তবে ঝিকাতলায় ফরহাদদের বাসায় টিউবওয়েল আছে, কলতলা আছে। একতলা বাসা। তিন ইঞ্চি গাঁথুনীর দেয়াল উপরে টিনের ছাদ। টিউবওয়েলের পেছনে গ্রামের বাড়ির মত কলাগাছ। সব মিলিয়ে পাঁচটা গাছ। একটায় থোর বের হয়েছে।
টিনের দেয়াল দিয়ে ঘেরা সাত কাঠা জায়গায় চার কামরার এই বাড়ির মালিক ফরহাদের খালাতো ভাই রহমত উল্লাহ। ভদ্রলোক থাকেন সুইডেনে। বছর চারেক আগে এক সুইস মেয়ে বিয়ে করেছেন। তিনি যে দেশে ফিরবেন এবং এই জায়গার দখল নেবেন সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই ভরসাতেই ফরহাদের বাবা নিজের শখ মিটিয়ে বাড়ির চারপাশে গাছ পালা লাগিয়েছেন। তার নিজের হাতে লাগানো নারিকেল গাছে নারিকেল ধরে গেছে। গত বছর জাম্বুরা গাছে ছাপ্পান্নটা জাম্বুরা হয়েছিল। কমলার মত মিষ্টি জাম্বুরা। সবই পাড়াপড়শিকে বিলি করা হয়েছে। তবে তিনি ঠিক করেছেন এ বছর থেকে কিছু ফল ফলান্তি বিক্রি করবেন। গাছের পেছনে খরচ আছে, সার কিনতে হয়। হাফ কেজির এক প্যাকেট জৈব সার পঁচিশ টাকা। গোবর কিনতেও অনেক টাকা লাগে। এক বস্তা ভাল গোবর পঁচাত্তর টাকা। কেরিং খরচ আছে নার্সারীর গাছ কিনতেও টাকা লাগে। কলমের একটা দারচিনি গাছ তার খুব মনে ধরেছে। টবের গাছ, দাম চাচ্ছে তিনশ। কুলাকুলি করলে দুশতে দিয়ে দেবে। এইসব খরচপাতির জন্যে ছেলের কাছে হাত পাতার অর্থ হয় না। ফল বিক্রির টাকায় ছছাটখাট খরচ সামাল দেয়া যায়। দশ টাকা করে ধরলেও ছাপ্পান্নটা জাম্বুরার দাম হয় পাঁচশ ষাট টাকা।
ফরহাদ কলের পাড়ে সাবান ডলে গোসল করছে। পাশে বসে গভীর আগ্রহের সঙ্গে ছেলের স্নানের দৃশ্য দেখছেন বেগম রোকেয়া গার্লস হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অংক শিক্ষক জোবেদ আলি। তিনি এখনো ভাত খাননি। ফরহাদ রাতে ফিরবে, ছেলের সঙ্গে খাবেন। এই জন্যেই অপেক্ষা। ফরহাদের মা রাহেলা বেগম ভাত চড়িয়েছেন। বোয়া উঠা সদ্য রাধা ভাত ফরহাদের অতি প্রিয়।
টিপটিপ করে বৃষ্টি এখনো পড়ছে। জোবেদ আলি এই বৃষ্টির মধ্যেও বসে আছেন। ফরহাদ বলল, বৃষ্টিতে যেভাবে ভিজছ তুমিতো বাবা ঠাণ্ডা লাগাবে।
জোবেদ আলি গম্ভীর গলায় বললেন, বৃষ্টি গাছের জন্যে যেমন দরকার মানুষের জন্যেও তেমন দরকার। বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ বিসুখ হয় না। ঘুসঘুসা জ্বরের মহৌষধ হল বৃষ্টি। অদ্রিা রোগের জন্যেও বৃষ্টি ভাল।