ফরহাদ উঠে পড়ল। বাবার সামনে বসে থাকলে তিনি ক্রমাগতই কথা বলতে থাকবেন। শুধু শুধু দেরী হবে।
জোবেদ আলি বললেন, তোর দাদাজানকেও বিয়ের কথাটা নিজের মুখে বলিস। মুরুব্বী মানুষের দোয়া বিয়ে শাদীতে অত্যন্ত দরকার। তোর দাদাজান জেগে আছে—এখনি বলে যা।
এত রাতে দাদাজান জেগে আছেন কেন?
জানি না। সন্ধ্যা থেকে বিড়বিড় করছে।
শরীর খারাপ না-কি?
শরীর খারাপ হলেতো ঝিম মেরে থাকবে। বিড়বিড় বিড়বিড় করবে না। শরীর মনে হয় ভালই।
ফরহাদ দাদাজানের ঘরে ঢুকল। ঘর অন্ধকার। দাদাজানের খাটে মশারী ফেলা। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে তিনি মশারীর ভেতর বসে আছেন—দৃশ্যটাই অস্বাভাবিক। হঠাৎ বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগে। ফরহাদ বলল, দাদাজান জেগে আছেন?
মেম্বর আলি বললেন, হুঁ।
শরীর খারাপ না-কি?
শরীরটা আজ ভাল।
জেগে আছেন কেন? ঘুম আসছে না?
খুব ভুখ লেগেছে। এইজন্যে ঘুম আসছে না।
রাতে খান নি?
সন্ধ্যাবেলা বৌমা সাগু দিয়েছিল।
এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?
হুঁ।
কি খাবেন?
পোলাও খেতে ইচ্ছা করতেছে।
এত রাতে পোলাও কোথায় পাব দাদাজান?
জাহানারা পোলাও পাঠায়েছে।
ও আচ্ছা। আপনি খাবেন? দেব গরম করে?
দে।
পেট খারাপ করবে নাতো?
মেম্বর আলি হতাশ গলায় বললেন, খুব ভুখ লেগেছে রে ব্যাটা। পিরিচে করে সামান্য এনে দে খাই। কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা আমি নিয়ে আসি।
আমি তোর জন্যেই জেগে বসেছিলাম। আর কেউ খেতে দিক না দিক তুই যে দিবি এটা আমি জানি।
ফরহাদ পোলাও গরম করল। লেবু কাটল, কাচামরিচ নিল, ঘরে আমের আচার ছিল, প্লেটের কোণায় সামান্য আচারও নিল। বুড়ো যখন কুপথ্য করবে ভালমতই করুক। সাগু খেলেও পেট খারাপ, পোলাও খেলেও পেট খারাপ। ভাল জিনিশ খেয়েই পেটটা খারাপ করুক।
খাবার সাজিয়ে ঘরে ঢুকে ফরহাদ দেখল দাদাজান বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছেন। গাঢ় ঘুম। অনেক চেষ্টা করেও সেই ঘুম সে ভাঙ্গাতে পারল না। এম্নিতেই অনেক রাত হয়েছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। ফরহাদ বাতি নিভিয়ে দিল। আজ নান্টু ভাইয়ের কাছে না গিয়ে সকালে গেলে কেমন হয়? শরীর দুর্বল লাগছে। শেষ পর্যন্ত সে যাওয়াই ঠিক করল। তার মন বলছে যে উদ্বেগের ভেতর সে আছে—নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে সেটা অনেকটা কমবে। বাগানে নেমেই ফরহাদ দেখল—গেটের কাছে গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে নামছে মঞ্জু। মঞ্জুর হাতে সিগারেট। বড় ভাইকে দেখে সে সিগারেট ফেলে দিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কি বের হচ্ছ?
হ্যাঁ।
এত রাতে?
জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। যেতেই হবে।
কোথায় যাবে?
আগামাসিহ্ লেন।
এক কাজ কর গাড়ি নিয়ে যাও।
কার গাড়ি?
ভাড়া গাড়ি। সারা দিনের জন্যে ভাড়া করেছিলাম। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
তাহলে তো ভালই হয়।
ফরহাদ মঞ্জুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণ আছে। মঞ্জু খুব স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না–সামান্য টলছে। মঞ্জুর মুখ ভর্তি জর্দা দেয়া পান। জর্দার কড়া গন্ধ মদের গন্ধ ঢাকতে পারছে না।
মঞ্জু কি একা একা হেঁটে বাসায় ঢুকতে পারবে। গেটের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে নাতো? সবচে ভাল হয় তাকে ধরে ধরে বাসায় নিয়ে যাওয়া। সেটাও ঠিক হবে না। মঞ্জু লজ্জা পাবে। মানুষকে লজ্জা দিয়ে লাভ কি?
একটা কাজ করলে কেমন হয়? গাড়ি যখন আছে তখন ড্রাইভারকে বললে হয় না—আগামসি লেনে যাব না। আমাকে উয়ারীতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। রাত খুব বেশি হয় নি। তাছাড়া ঐ বাড়িতে আজ উৎসব। উৎসবের বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই অনেক রাত পর্যন্ত জাগবে। একটাই সমস্যা জাহানারা নানান ধরনের আহ্লাদী করবে। এটা খাও, ওটা খাও। ওমা এত রোগা হয়েছ কেন? চোখের নিচে কালি কেন?
সহজ স্বাভাবিক মেয়েরা বিয়ের পরে ন্যাকা ধরনের হয়ে যায়। বাপের বাড়ির কাউকে পেলে নানান ধরনের ন্যাকামী করে। যাকে নিয়ে ন্যাকামী করা হচ্ছে তার কাছে যে ব্যাপারটা অসহ্য লাগে তা বুঝতেই পারে না।
শেষবার যখন ফরহাদ গিয়েছিল জাহানারা ধরা গলায় বলল, ভাইয়া আমি তোমার বোন না? ছমাস পর তুমি আমাকে দেখতে এলে? কেন এসেছ? না তুমি বসতে পারবে না। তুমি চলে যাও। বলতে বলতে কেঁদে কেটে বিশ্রী অবস্থা। ফরহাদের ধারণা জাহানারার ন্যাকামী বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে।
ফরহাদ ড্রাইভারকে বলল, ড্রাইভার সাহেব আমাকে আগামসি লেনে নামাতে হবে না। উয়ারীতে নামিয়ে দেন।
ড্রাইভার বিরক্ত মুখে বলল, আগে কইবেন না?
আগে না বলাটা খুবই অন্যায় হয়েছে ক্ষমা করে দিন।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মনে হয় বৃষ্টি হবে। জাহানারার বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। ফরহাদের মন বলছে সে বাড়িতে ঢুকবে এবং শুরু হবে বৃষ্টি। জাহানারা শুরু করবে ন্যাকামী। না ভাইয়া তুমি যেতে পারবে না। বৃষ্টির মধ্যে তুমি যদি যাও আমি কিন্তু ভয়ংকর কিছু করে বসব। তুমি আজ কতদিন পর এ বাড়িতে এসেছ ভেবে দেখ।
বৃষ্টি নামল না কিন্তু জাহানারা ভাইকে দেখে ন্যাকামীর চূড়ান্ত করল। কিছু মুখে না দিয়ে সে ফরহাদকে যেতে দেবে না। সেই কিছু মানে পোলাও মুরগির রোস্ট। খাবার কম পড়েছিল বলে নতুন করে রান্না হয়েছে। নতুন রান্না মুখে দিতেই হবে। ফরহাদ যদি না পায় সে খাবে না। দুপুরেও সে ঝামেলার জন্যে খেতে পারে নি।