গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। রবীন্দ্রসংগীত এখনো চলছে। তবে এখন শুনতে ভাল লাগছে। এখন মনে হচ্ছে বুড়ো রবীন্দ্রনাথ গানগুলি খারাপ লেখেনি।
হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ডালে,
কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে
পায়ে তাল দিতে ইচ্ছে করছে। সাহসে কুলুচ্ছে না। বড় সাহেবের চোখে পড়তে পারে। মুরুব্বীদের সামনে পা নাচানোটা খুবই অদ্রতা। পুরো পা না নাচিয়ে বুড়ো আংগুল নাচালে হয়। জুতার ভেতর বুড়ো আংগুল কি করছে না করছে কে দেখবে। বুড়ো আংগুল নাচালে রক্ত চলাচলটাও ঠিক থাকবে। পায়ে আগের মত ঝিঝি ধরবে না।
ফরহাদ!
ফরহাদ চমকে উঠল। বড় সাহেব তাকে ডাকছেন। তিনি যে তার নাম জানেন এটাই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
জি স্যার!
কটা বাজে?
এগারোটা দশ।
বড় সাহেব আবার চুপ করে গেলেন। ফরহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস তার হাতে রেডিয়াম ডায়াল দেয়া ঘড়ি ছিল। নয়তো সময় বলতে পারতো না। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। তিনি অপরিচিত কেউ হলে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাই সাহেবের কি শরীর খারাপ? এখন তা জিজ্ঞেস করা যাবে না। তিনি প্রশ্ন করলেই শুধু জবাব দেয়া যাবে। তিনি যদি বলেন, আমার শরীরটা ভাল না তবেই শুধু উদ্বেগ নিয়ে বলা যাবে, স্যার কি হয়েছে?
বড় সাহেব বললেন, ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে? প্রশ্নটা কাকে করা হল ফরহাদ বুঝতে পারছে না। কারণ বড় সাহেবের চোখ বন্ধ। তিনি কারো দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন নি। প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে করা হয়েছে। ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে তা বলতে পারে ড্রাইভার। সে কত স্পীডে গাড়ি চালাবে তা সেই জানে। অথচ ড্রাইভার জবাব দিচ্ছে না। ফরহাদ খুবই অস্বস্তি বোধ করছে। বড় সাহেব একটা প্রশ্ন করলেন। গাড়িতে তিনজন মানুষ কেউ জবাব দিল না–অথচ তিনজন মানুষই প্রশ্নটা শুনেছে—তার মানে কি?
ফরহাদ বলল, স্যার আমরা ইনশাল্লাহ এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।
তুমি কোম্পানীতে জয়েন করছ কবে? এক বৎসর দুই মাস হয়েছে। চাকরি ভাল লাগছে? জ্বি স্যার। খাটুনি বেশি?
ফরহাদ জবাব দিল না। খাটুনি বেশীলতা বটেই, জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানো আরামের ব্যাপার না। খাটুনি বেশী বললে স্যার ভাবতে পারেন—খাটুনি বেশী তাহলে ঝুলে আছ কেন? চাকরি ছেড়ে দাও। আর সে যদি বলে কোন খাটুনি নেই। তাহলে আদিখ্যেতা দেখানো হয়। মনে হয় বড় সাহেবকে দেখে সে চামচাগিরি করছে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বেশ ভাল বৃষ্টি। ড্রাইভার গাড়ি স্লো করে দিয়েছে। ফরহাদ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। এভাবে গাড়ি চালালে এক ঘন্টায় ঢাকা পৌছানো যাবে না। দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। স্যার তখন বিরক্ত হয়ে ভাবতে পারেন—এ কেমন ছেলে কোন অনুমান নেই। দেড় ঘন্টা লাগবে, বলে বসেছে এক ঘন্টা। এইসব বেআক্কেল কর্মচারীদের কোম্পানীতে থাকা ঠিক না।
গাড়ি এখন গাজিপুর চৌরাস্তা পার হচ্ছে। এখান থেকে ঢাকা কতদূর-চল্লিশ কিলোমিটার? ঘন্টায় এক কিলোমিটার করে গেলেওতো চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাবার কথা। ড্রাইভার গাড়ি স্লো চালাচ্ছে ঠিকই তাই বলে ঘন্টায় ষাট কিলোমিটারের নিচে চালাচ্ছে বলেতো মনে হয় না। ফরহাদ একটু সামনে এগিয়ে স্পিডোমিটার দেখার চেষ্টা করল। আর এতেই পায়ের কাছের দৈ-এর হাড়িতে মট করে শব্দ হল।
সর্বনাশ হাড়ি ভাঙ্গে নিতো?
ভাঙ্গা হাড়ি চুইয়ে দৈ পড়বে। দামী গাড়ি মাখামাখি হবে। স্যার ভাববেন এই বেকুব সামান্য একটা দৈয়ের হাড়িও ঠিকঠাকভাবে রাখতে পারে না?
ফার্মগেটে গাড়ি থামলো।
ফরহাদ গাড়ি থেকে নামলো। তার খুবই লজ্জা লাগছে। তার জন্যে বড় সাহেবকে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গাড়ি থামতো আর সে চট করে নেমে যেত তাহলেও একটা কথা ছিল। তাতো না, গাড়ির ট্রাংক খুলে হ্যান্ড ব্যাগ বের করতে হচ্ছে। তার ভাগ্যটা এমনই যে ট্রাংক খুলছে না। কি যেন আটকে গেছে—ড্রাইভারকে ঘট ঘট করতে হচ্ছে। তিনবারের চেষ্টায় ট্রাংক খুললো। ফরহাদ বড় সাহেবের জানালার কাছে এসে বিনীত গলায় বলল, স্যার যাই?
বড় সাহেব জানালার কাচ নামালেন। এটা অসাধারণ জ্বতার একটা ব্যাপার। বৃষ্টি হচ্ছে, এর মধ্যে জানালার কাচ নামানোর দরকার ছিল না। ফরহাদ দ্বিতীয়বার বলল, স্যার যাই। স্নামালিকুম।
বড় সাহেব বললেন, একটা দৈয়ের হাড়ি নিয়ে যাও।
ফরহাদ অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলল, জ্বি না স্যার।
না কেন নিয়ে যাও। আমি এত দৈ দিয়ে কি করব। মোকাদ্দেস একে এক হাড়ি দৈ দিয়ে দাও তো।
বড় সাহেব জানালার কাচ উঠিয়ে দিলেন। এখন আর কথা চলে না। মোকাদ্দেস বিরক্ত মুখে দৈয়ের হাড়ি ফরহাদের হাতে ধরিয়ে দিল।
বারোটা ত্রিশ বাজে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। ফরহাদ যাবে ঝিগাতলা। বেবীটেক্সী নিতে হবে। এত রাতে রিকশা করে যাওয়া ঠিক হবে না। হ্যান্ড ব্যাগ, দৈয়ের হাড়ি সব যাবে। খবরের কাগজের ভাষায়—গভীর রাতে দৈ ছিনতাই।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অর্থ হয় না। কোন দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেট ধরানো যেতে পারে। শেষ সিগারেট দুটা টান দিয়ে ফেলে দিতে হয়েছিল। এবারেরটা ফিল্টার পর্যন্ত খাওয়া যাবে। তবে ফিনফিনা বৃষ্টিতে ভিজতেও খারাপ লাগছে না। তার ঠিক সামনেই একটা পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পে অপেক্ষা করা যায়। সমস্যা একটাই পেট্রল পাম্পে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাছাড়া পেট্রল পাম্পে খারাপ টাইপের একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে পেট্রল নিতে আসবে এমন কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদকে দেখে এই মেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। ফরহাদ তার দিকে তাকিয়েছিল বলে এখনই সে খানিকটা উসখুস করছে। পেট্রল পাম্প ছেড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার কাছে চলেও আসতে পারে। প্রথমবার মেয়েটা যা করবে তা হল গম্ভীর ভঙ্গিতে সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। একবারও তাকাবে না। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসবে তখন থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাবে এবং হাসবে। তারপর ফরহাদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে আসতে থাকবে। দূর থেকে মেয়েটাকে সুন্দর দেখা গেলেও কাছে যখন আসবে তখন দেখা যাবে কুৎসিত। শরীর এবং মনের অত্যাচার মেয়েটার মুখে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে।