তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি খেতে বোস।
ফরহাদ খেতে বসল। আসমানীর মা কঠিন মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এই অবস্থায় খাওয়া যায় না। গলায় ভাত আটকে যায়। ফরহাদের গলায় ভাত আটকে যেতে লাগল। আসমানীর মা বললেন, তুমি যাওয়ার পথে বড় রাস্তার পলাশ ফার্মেসী বলে একটা ফার্মেসী দেখবে। ফার্মেসীর যে কোন একজনকে বলবে আসমানীর শরীর খারাপ। তারা ডাক্তার পাঠাবে।
আসমানীর নাম বললেই হবে?
হ্যাঁ নাম বললেই হবে। ওর ছোট মামা ডাক্তার। সে ঐ ফার্মেসীতে বসে। ফার্মেসীর উপরের তলায় তার বাসা।
জ্বি আচ্ছা বলব।
তুমি ভালমত খাওয়া শেষ কর। আসমানীকে নিয়ে দুঃচিন্তা করার কিছু নেই—মাঝে মধ্যে ওর এ রকম শরীর খারাপ করে। ঘর বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে রেস্ট নিলে শরীর সেরে যায়। আলু ভাজি নিচ্ছ না কেন? আলু ভাজি নাও—আসমানী তোমার জন্য করেছে। বাটিতে ঘি আছে ঘি নাও।
ফরহাদ ভেবেছিল চলে আসার সময় আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে তাও হল না। সে মন খারাপ করে পলাশ ফার্মেসীর দিকে রওনা হল। ডাক্তার সাহেবকে খবর দিয়ে বাসায় ফিরল হাঁটতে হাঁটতে। খুব যখন মন খারাপ থাকে তখন রিকসায় চড়তে ভাল লাগে না। হাঁটতে ইচ্ছা করে।
জোবেদ আলি অন্ধকার বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। ছোট ছেলের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদ বাসার গেটে হাত রাখা মাত্র জোবেদ আলি বললেন, কে মঞ্জু?
ফরহাদ বলল, জ্বি না আমি। আপনি এখনো জেগে আছেন? ঘুম আসছে না?
জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন—ঘুম আসবে কি ভাবে? বাগানের সব গাছ পাড়িয়ে মেরে ফেলেছে।
কে মেরেছে?
মঞ্জু মেরেছে। আর কে মারবে। এরিকা জাপানিকা গাছটার কি অবস্থা করেছে। আয় দেখে যা।
অন্ধকারে দেখব কি ভাবে?
আয় আমার হাতে টর্চ আছে।
ফরহাদকে বাবার সঙ্গে বাগানে যেতে হল। জোবেদ আলি টর্চ ফেলে বললেন-ভাল করে দেখ। সুস্থ সবল একটা গাছের কি অবস্থা করেছে। মানুষকে মানুষ খুন করলে তার বিচার আছে। আইন আদালত আছে, শাস্তি আছে। অথচ গাছ হত্যা করলে তার শাস্তির বিধান নাই। গাছওতো জীবন। গাছ হত্যার শাস্তি আরো বেশী হওয়া উচিত কারণ গাছের জীবন থাকলেও সে প্রতিবাদ করতে পারে না, কেউ যখন তাকে হত্যা করতে আসে সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারে না। ঠিক বলেছি কি-না বল।
ফরহাদ বাবার প্রশ্নের জবাব দিল না কলঘরের দিকে রওনা হল। তার নিজের শরীরও খারাপ লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বে। জোবেদ আলি ছেলের পেছনে পেছনে কলঘরে চলে এলেন।
তোর খাবার টেবিলে টিফিন কেরিয়ারে রাখা আছে। খেয়ে নে—আজ তোর মা জাহানারার কাছে গিয়েছিল। সে কাচ্চি বিরিয়ানী দিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে নিতে হবে।
জাহানারার কথা বলতেই ফরহাদের মনে পড়ল তার পকেটে আংটিটা রয়ে গেছে। দেয়া হয়নি। আজ আকীকা আজই দেয়া দরকার ছিল। আংটি ঠিকই কেনা হয়েছে। দেয়ার কথা মনে হয় নি। জোবেদ আলি বললেন, হাত ধুয়ে খেতে আয়।
ফরহাদ বলল, আমি খেয়ে এসেছি।
দাওয়াত ছিল?
হ্যাঁ।
দাওয়াত থাকলে আগে বলে যাবি। সবার জন্যে রান্না হয়। খাবার নষ্ট হয়। আজ তিনজনের ভাত নষ্ট হল। তোর আমার আর মঞ্জুর।
তুমি খাও নি?
খাও নি কেন?
মঞ্জুর উপর রাগ করে খাই নি। কেমন বেয়াদপের মত চারাটা নষ্ট করল। রাগের চোটে ক্ষিধে নষ্ট হয়ে গেছে ভাত কি খাব।
এসো খেতে এসো।
জোবেদ আলি আপত্তি করলেন না ছেলের সঙ্গে খেতে গেলেন। টিফিনকেরিয়ারে কাচ্চিবিরিয়ানী ছাড়াও ঘরে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। তিনজনের জন্যে তিনপিস ইলিশ মাছ ছিল। জোবেদ আলি তিন পিসই খেয়ে ফেললেন। আনন্দিত গলায় বললেন–সর্ষে ইলিশ রান্না খুবই জটিল। বাংলাদেশের খুব কম মেয়ে সর্ষে ইলিশ রাধতে পারে। তোর মা আগে পারত না। তোর দাদী হাতে ধরে রান্না শিখিয়েছে। এখন তোর মার কাছ থেকে ঐ বিদ্যা শিখে নেয়া দরকার। তোর বিয়ে হলে বৌমাকে প্রথম যে কাজটা করতে বলব সেটা হচ্ছে—শাশুড়ির কাছ থেকে সর্ষে বাটা রান্না শিখে নেয়া। বৌমা ঐ বিদ্যা শেখাবে তার ছেলের বৌকে…ঐ ভাবে চলতে থাকবে।
ফরহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। জোবেদ আলি এখন আংগুল চুষে চুষে সর্ষে ইলিশের ঝোল খাচ্ছেন। তিনি ছেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোর হাতে টাকা পয়সার অবস্থা কেমন?
ভাল না। কেন?
টাকা পয়সার অবস্থা ভাল থাকলে জাপানিকা গাছের একটা চারা কিনতাম! সবুজ ফুল হয়। ডেনজারাস না?
চারা কিনতে কত লাগবে?
আড়ইশ টাকা দাম। আমাকে অবশ্যি দেড়শতে দিয়ে দিবে।
ফরহাদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা একশ টাকার নোট পানির গ্লাসের নিচে চাপা দিল। বাবাকে সরাসরি টাকা দিতে লজ্জা লাগছে। সব সময় লাগে। তাকে টাকা দিতে গেলেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। স্কুলে বনভোজন পনেরো টাকা চাঁদা। সেই চাঁদার জন্য এক সপ্তাহ ধরে বাবার পেছনে পেছনে ঘোরা। বাবার কত কঠিন কঠিন কথা।
বনভোজন আবার কি? বন আছে না-কি যে বনভোজন? স্কুলের মাঠে আবার বনভোজন কি। মাঠ-ভোজন। দশ টাকা নিয়ে যা—ওদেরকে বল, আমার কাছে দশটাকাই আছে। নিলে নাও। না নিলে নাই। মাঠ ভোজনের জন্যে পনেরো টাকা এক আশ্চর্য ব্যাপার। ঘরে ঘরে যেন টাকশাল আছে। টাকা ছাপালেই হল।
এখন চাকা ঘুরে গেছে। এখন জোবেদ আলি শুকনা মুখে ছেলের পেছনে পেছনে ঘুরেন।
জোবেদ আলি ডালের বাটিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন দুইশ লাগবে না তুই পঞ্চাশ টাকা রেখে দে। সংসারের এই অবস্থা। এখন বাজে খরচ করা ঠিক না।