ঘুমের অষুধ খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নিয়ম নেই। আধ ঘন্টা ঠাণ্ডা মাথায় সময় কাটিয়ে ঘর অন্ধকার করে ঘুমুতে যেতে হয়। মাথা ঠাণ্ডা হবে কি ভাবে? ঘুমের অষুধ খাবার পর পর এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যে মাথা গরম হতে শুরু করে। একজন ভাত খাবে না, গাছের শোকে পাথর। স্বামীকে অভুক্ত রেখে ঘুমুতে যাওয়া সংসারের জন্যে অমঙ্গলের।
এই কাজটাই তাকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। চুলা ধরিয়ে খাবার গরম করার কথা বলেছেন। এটা নিয়েও দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে—চুলা ধরিয়ে ঠিকমত নিভাবেতো? গ্যাসের চুলার চাবিতে কিছু সমস্যা আছে। চাবি বন্ধ করলেও ঠিকমত বন্ধ হয় না। গ্যাস বের হতে থাকে। একবার খবরের কাগজে পড়েছিলেন—-গ্যাসের চুলা বন্ধ ঠিকমত করা হয়নি বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল গ্যাসে। তখন বাড়ির কর্তা সিগারেট ধরাবার জন্যে ম্যাচ জ্বালিয়েছেন ওমি সারা বাড়িতে আগুন লেগে গেল। এক পরিবারে পাঁচজনের মৃত্যু। বেঁচে রইল শুধু বুড়ো নানী। এই অর্থব প্যারালিসিসের রোগী নড়তে পর্যন্ত পারে না। সে একা টিকে গেল। আল্লাহর বিচার বোঝা খুবই মুশকিল।
রাহেলা ঘড়ি দেখলেন, আধ ঘন্টা পার হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে। তিনি শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন। জেগে থাকলে দু একটা ভাল কথা বলবেন। আজ দুপুরে বুড়োর সঙ্গে খুব চেঁচামেটি করেছেন। বুড়োর তেমন দোষ ছিল না। খুব যারা বুড়ো তাদের কিছু বুঝতেই পারে না। তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলেও তারা বুঝে না। খারাপ ব্যবহার করলেও বুঝে না।
রাহেলা ঘরে ঢোকা মাত্র মেম্বর আলি বললেন, কে বউমা। ভাল আছ?
রাহেলা বললেন, জ্বি ভাল।
খাওয়া দাওয়া করেছ?
জ্বি।
আলহামদুলিল্লাহ। আমারে খেতে দিবা না?
সন্ধ্যার সময় না আপনারে খাওয়ায়ে গেলাম।
নাশতা হিসাবে খেয়েছিলাম এখন আবার ভুখ চাপছে।
এই বয়সে খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করা যাবে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে। পেট ছেড়ে দিবে। এই বয়সে পেট ছেড়ে দিলে সর্বনাশ।
ঘরে কি আজ পোলাও হয়েছে?
পোলাও হবে কেন? এটা কি রাজবাড়ি যে প্রতিদিন পোলাও হবে।
পোলাওয়ের গন্ধ পেয়েছি।
জাহানারার বাসা থেকে সামান্য কাচ্চি বিরিয়ানী পাঠিয়েছে। আজ তার মেয়ের আকীকা ছিল।
তস্তুরীতে করে একটু বিরিয়ানী দাও। খেয়ে দেখি।
বিরিয়ানী আপনাকে দেওয়াই যাবে না। এই বয়সে বিরিয়ানী আপনার জন্যে বিষ। লোভ কমাতে হবে।
গন্ধটা নাকে গেলতো…তারপর থেকে।
এত গন্ধ নিতে হবে না। আপনি ঘুমান।
নাম কি?
কিসের নাম কি?
জাহানারা মেয়ের নাম কি রেখেছে?
হোসনে আরা খানম।
আলহামদুলিল্লাহ্ সুন্দর নাম। জাহানারাকে বলবা আমি তার কন্যার জন্যে খাস দিলে দোয়া করেছি।
আচ্ছা বলব। এখন আপনি ঘুমান।
পেটে ভুখতো ঘুম আসতেছে না।
পানি খাবেন? এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকেন।
খালি পেটে পানি খাওয়াও ঠিক না। পিত্তনাশ হয়। আচ্ছা মা যাও। তুমি ঘুমাতে যাও।
রাহেলা ঘুমুতে গেলেন। এবারের ঘুমের অষুধগুলি ভাল—তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।
ফরহাদ ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। আসমানীকে বাসায় নামাতে গিয়ে দেরী হল। আসমানীর মা তাকে খেয়ে যেতে বললেন। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। আসমানী বলল, আমার শরীর এখন খুবই ভাল লাগছে। আমি রান্না করব।
ফরহাদ বলল, তুমি ভয়ংকর অসুস্থ। রান্নার নামও মুখে আনবে না।
আসমানী বলল, একবার যখন বলেছি রান্না করব, তখন রান্না করবই।
ফরহাদ বলল, আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসি সে দেখুক তোমার প্রেসারের কোন সমস্যা আছে কি-না। তুমি অজ্ঞানের মত হয়ে গিয়েছিলে।
আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি। ভান করছিলাম। আমি অজ্ঞান হলে তুমি কি কর এটাই আমার দেখার ইচ্ছা ছিল।
বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। সবাই কার যেন জন্মদিনে গিয়েছে। ফরহাদকে একা একা বসে থাকতে হল। একটু পর পর আসমানী এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিল।
এই যে বাবু সাহেব! খুব বোর হচ্ছ?
না।
তোমার জন্যে খুব কিছু রান্নার করার ইচ্ছা ছিল। ঘরে কিছু নেই। ডীপ ফ্রীজে সব সময় কিছু না কিছু থাকে। আজ ডীপ ফ্রীজ খালি। আমি তোমার জন্যে আলু ভাজি করছি। আলু ভাজি খাও?
খাই।
গাওয়া ঘি মাখিয়ে আলু ভাজি। দেখ খুব ভাল লাগবে। সঙ্গে থাকবে ভাজা শুকনা মরিচ।
ভাল।
শুধু একটাই সমস্যা ঘরে পাতে খাবার ঘি নেই।
আসমানী তুমি আমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না।
তোমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হবোনাতো কার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হব? এখন বল চা খাবে না, সরবত খাবে। মামা জাপান থেকে সবুজ রঙের কি একটা সিরাপ এনেছেন। সিরাপের সরবত খুব ভাল হয়। এক গ্লাস বানিয়ে দিই?
দাও।
আমার ইচ্ছা করছে রান্না ঘরে তোমার জন্যে মোড়া পেতে দেই। তুমি মোড়ায় বসে আমার রান্না দেখবে আর আমি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। মা খুবই রাগ করবে বলে বলতে পারছি না। আচ্ছা শোন, তুমি কি কোন গল্পের বই পড়বে। গল্পের বই এনে দেব?
কিছু আনতে হবে না। তুমি রান্না শেষ কর।
সবুজ রঙের সরবত এনে আসমানী উজ্জ্বল মুখে বলল, পাতে খাব ঘি সমস্যার সমাধান হয়েছে। ঘরে একটিন মাখন আছে-মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি করব।
ভাল। কর।
যাই কেমন।
রাত দশটায় আসমানীর মা এসে গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি খেতে এসো। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। আসমানীর শরীর খুবই খারাপ। সে খাবে না শুয়ে পড়েছে।
বেশী খারাপ?
বেশী খারাপতো বটেই জোর করে আগুনের কাছে গিয়েছে।
আমি ওকে একটু দেখে আসি।