বললামতো আসার দরকার নাই।
এই শেষ আসা।
আচ্ছা।
এই বৃক্ষপ্রীতি জোবেদ আলির আগে ছিল না। রিটায়ার করার পর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা তত বাড়ছে। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি সাত মসজিদ রোডের এক নার্সারিতে বসে থাকেন। নার্সারির লোকদের সাহায্য করেন। গোবর মাটি এবং ডাস্টবিনের আবর্জনা মাখিয়ে বৈ সার বানান। গায়ে পড়া কোন সাহায্যই মানুষ সহজ ভাবে নিতে পারে না। তার এই সাহায্যও কেউ সহজ ভাবে নেয় না। লোকটার আসল মতলব খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।
টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলাম। যদি খেতে ইচ্ছা করে খেয়ে আমাকে মুক্তি দিও।
আচ্ছা।
টিফিন কেরিয়ারে দুজনের মত কাচ্চি বিরিয়ানী আছে। জাহানারা দিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা।
ফরহাদকে বলবে কষ্ট করে যেন গরম করে নেয়। আমি রাত জাগতে পারব ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলেছি।
ভাল করেছ। আরো দুটা ঘুমের অষুধ খাও।
এটা কি কথা বললে?
জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন, বলে ফেলেছি বলে ফেলেছি। এখন আমাকে কি করবে? মারবে?
রাহেলা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কথাবার্তার একি নমুনা। সামান্য একটা গাছ মরে গেছে আর লোকটা মাথা খারাপের মত কথাবার্তা বলছে। রাহেলা খুব কঠিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়েও নিজেকে সামলে ফেললেন। ঘুমের অষুধ খাবার পরে রাগারাগি চেঁচামেচি করলে অষুধের ধার কমে যায়। বিছানায় শুবেন ঘুম আসবে না। এরচে ঝগড়াটা কিছু সময়ের জন্যে মূলতুবী থাকুক। স্বামীকে তিনি এত সহজে ছেড়ে দেবার মত মানুষ না। তাছাড়া মেয়ের বাড়িতে যাবার কারণে আজ তার মেজাজ ভাল। আকিকা উপলক্ষে তিনি শেষ পর্যন্ত নাতনীকে একটা চেইন দিতে পেরেছেন। তাঁর গোপন সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়েছে। তার জন্যে মেজাজ সামান্য খারাপ ছিল। কিন্তু চেইন দেখে জাহানারা এতই খুশি হল যে মেজাজ খারাপ ভাব সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। জাহানারা অবশ্যি বলেছে—ইশ মা তোমাকে গলার চেইন দিতে কে বলেছে? নাতনীকে দোয়া করবে—তা না।
দোয়াতো সব সময়ই করি।
এত টাকা খরচ করা তোমার ঠিক হয়নি মা।
একটা লকেটও দেয়ার ইচ্ছা ছিল। হাত একেবারে খালি।
এই রকম বাজে খরচ তুমি করো নাতো মা।
রাহেলা মেয়ের খুশি দেখে খুবই তৃপ্তি পেলেন। ভাগ্যিস আংটি না কিনে শেষ মুহূর্তে সোনার চেইন কিনেছেন। না কিনলে খুব বোকামী হত।
জাহানারা বলল, তোমার জামাই মেয়ের আকিকা উপলক্ষ্যে আমাকে কি দিয়েছ দেখ মা। দুটা বালা বানিয়ে দিয়েছে। একেকটা এক ভরি করে। ডিজাইন আমার পছন্দ হয় নি। কিন্তু আমি কিছু বলিনি বেচারা শখ করে কিনেছে।
কই ডিজাইনতো আমার কাছে সুন্দর লাগছে।
সবাই সুন্দর বলছে কিন্তু আমার কাছে ওল্ড ফ্যাশনড় মনে হচ্ছে। তাছাড়া বালা পরলে বয়স বেশি বেশি লাগে। আমি এগুলি ভাঙ্গিয়ে পাতলা করে চারটা চুড়ি বানাব। সব সময় পরা যায় এমন চুরি।
ভুলেও এই কাজ করবি না। জামাই জানতে পারলে মনে কষ্ট পাবে।
ও জানতেই পারবে না। একমাস পরে নিজেই ভুলে যাবে যে আমাকে বাবা দিয়েছিল।
জামাইয়ের ব্যবসা কি ভাল যাচ্ছে না-কি।
ওদেরতো মা অনেক রকম ব্যবসা। একটা খারাপ গেলে অন্যটা ভাল যায়। তুমি এসেছ খুব ভাল হয়েছে। তোমার সঙ্গে আমার খুবই জরুরী কিছু কথা আছে।
কি কথা?
এখন না। খাওয়া দাওয়া শেষ হোক তারপর বলব। মুখ এমন শুকনা করে ফেলেছ কেন? খারাপ কিছু না। খুবই ভাল একটা ব্যাপার আছে। তোমার জামাই আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। কাজেই আমি যা বলব সেটা হল অফিসিয়াল।
এখনই বল। আমার হাত পা কাঁপছে।
হাত পা কাপাতে হবে না। বললাম না, ভাল খবর।
জাহানারা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। রাহেলা মেয়ের হাসি দেখেও তেমন স্বস্তি পেলেন না। তাঁর জীবনে ভাল কিছু ঘটতে পারে এই বোধই নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর জীবনটা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে এখন ঘটনা মানেই দুর্ঘটনা। স্বপ্ন মনেই দুঃস্বপ্ন। রাহেলা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। নাতনীর আকীকা উপলক্ষ্যে তিন চারশ লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব। রাতে না-কি আবার কাওয়ালী হবে। বাচ্চু কাওয়ালকে খবর দেয়া হয়েছে। রাহেলার খুব ইচ্ছা কাওয়ালী দেখে যাওয়া। রাত বেশি হলেও সমস্যা হবে না। জামাইদের গাড়ি আছে। শাশুড়ীকে জামাই নিশ্চয়ই নামিয়ে দিয়ে যাবে।
কাওয়ালীর আসর থেকে জাহানারা মাকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাহেলার বুক ধরাস ধরাস করতে লাগল। জাহানারা গলা নামিয়ে বলল, মা আমার ননদকে তুমি দেখেছ রাণী নাম। দেখেছ না?
রাহেলা বললেন, হুঁ।
খুব সুন্দর মেয়ে না?
রাহেলা আবারো ক্ষীণ স্বরে বললেন, হুঁ।
এমন মিহি করে হু বলছ কেন? সুন্দর মেয়েকে সুন্দর বলতে সমস্যা কোথায়?
একটু মোটার ধাত আছে।
তা আছে। সেটা এমন কিছু না। মেয়েটা ভাল। নিজের ননদ বলে বলছি না—আসলেই ভাল মেয়ে।
রাহেলা মেয়ের কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারছেন না। মেয়ে ভাল হলে তার কি যায় আসে?
জাহানারা বলল, আমার শ্বশুর বাড়ির সবার খুব ইচ্ছা রাণীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে হোক। ভাইয়াকে তাদের সবার খুবই পছন্দ।
রাহেলা বললেন, ও এই ব্যাপার।
জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, মা তুমি দেখি পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দিলে। এরা সাত ভাইয়ের মধ্যে একটা বোন। সবার চোখের মণি। মেয়ের নামে একটা বাড়ি ঢাকা শহরে আছে। তার বয়স যখন বার তখনি তার বিয়ের জন্যে তিন সেট গয়না বানিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝতে পারছ কিছু?