সকালবেলা মামার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম আনিস। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স। লাজুক ধরনের মানুষ। গায়ের রঙ ময়লা হলেও অতি সুদর্শন। মেয়েদের মত টানা টানা চোখ। ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে মামাকে খবর দিতে গেলাম। মামা বললেন, ও আচ্ছা আনিস। ওকে বসতে বল। চা-টা খাওয়া। তোরা দুই বোন গল্প কর। আমি ঘন্টা দুএক না ঘুমিয়ে উঠতে পারব না। তোরা কোম্পানী দে। নিশা বলল, ভদ্রলোক কি করেন মামা?
মামা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জাহাজে কাজ করে। খালাসি ফালাসি হবে।
খালাসি বলেতো মনে হচ্ছে না।
মামা বিরক্ত গলায় বললেন, মানুষের কাপড় চোপড় দেখে কখনোই বিভ্রান্ত হবি না। চেহারা দেখেও হবি না। শেখ সাদীর বিখ্যাত গল্প মনে রাখবি।
মামা ঘুমুতে গেলেন। আমি খালাসি ভদ্রলোককে চা দিতে গিয়ে জানলাম ভদ্রলোক মোটেই খালাসি না। জাহাজের সেকেণ্ড ক্যাপটেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমি যখন ভদ্রলোককে বললাম—মামা বলেছেন আপনি জাহাজের খালাসি। উনি মজা পেয়ে খুব হাসলেন। আমি বললাম, জাহাজের গল্প বলুন। তিনি বললেন, জাহাজের কোন গল্প নেই। পৃথিবীর সবচে বিরক্তিকর এবং ক্লান্তিকর জিনিস হচ্ছে জাহাজের চারপাশের সমুদ্রের পানি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই জিনিস দেখলে যে কোন সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পরে।
আমি বললাম, হ্যাঁ। এখন আমার চিকিৎসা চলছে।
কী চিকিৎসা?
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, স্থল চিকিৎসা। স্থলে সময় কাটাচ্ছি এতেই কাজ হচ্ছে।
মামা দুপুর পর্যন্ত ঘুমুলেন। আনিস সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। নিশা তাকে ধরে রেখে দিল। দুপুরের মধ্যে এই ভদ্রলোক ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন। মার সঙ্গে গল্প করলেন, বাবার সঙ্গে গল্প করলেন। এবং দুপুরের খাবারের আগে বাবার একটা লুঙ্গি পরে বাথরুমে গোসল করতে গেলেন। তিনি আবার গোসল না করে খেতে পারেন না।
রাতে মামা চা খেতে খেতে আমার আর নিশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বললেন—এই আসমানী আনিস ছেলেটা কেমন?
আমি বললাম, খুব ভাল। ছেলেরা যতটা ভাল হয় তারচে একটু বেশি ভাল। আরেকটু কম ভাল হলেও ক্ষতি ছিল না।
সে যে অহংকারী কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিস?
না।
বেশ অহংকারী ছেলে। তবে দোষের অহংকার না। ওর দোষের মধ্যে একটাই মদ্যপান করে। জাহাজে চাকরি করলে যা হয়। কিছু করার নাই—তাই মদ খাওয়া। তুই অভ্যাসটা ছাড়িয়ে দিবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি অভ্যাস ছাড়াব কেন?
মামা বললেন, তুই না ছাড়ালে কে ছাড়াবে? স্বামীর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব স্ত্রীর না?
তুমি কি বলছ মামা?
আনিসের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। এই জন্যেই ছেলেকে আসতে বলেছি। আনিস যাবার সময় বলে গেছে তোকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। আর আমার ধারণা তোরও ছেলে পছন্দ হয়েছে। ব্যাস আমার দায়িত্ব শেষ। এখন যা করার করবেন কাজি সাহেব।
মামার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি শুরু করলাম কান্না। আমি যেমন হাসতে পারি, তেমন কাঁদতেও পারি। তুমিতো আমাকে কাঁদতে দেখনি। কাঁদতে দেখলে তোমার খবর হয়ে যেত।
কান্নার চোটে আমার হেঁচকি উঠে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগার হল। মামা নিশাকে জিজ্ঞেস করলেন—নিশা! ও এরকম করছে কেন? নিশা বলল, আপার একজন পছন্দের মানুষ আছে বলে এ রকম করছে।
মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, পছন্দের মানুষ থাকলে সে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে। আমি কি তাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছি না-কি? হাত পা ছড়িয়ে কাঁদার কি হল। এমন বিশ্রী কান্না সে কোথায় শিখল?
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কান্না বন্ধ করে বল কাকে বিয়ে করতে চাস। যা তাকে ধরে নিয়ে আয়। যা আজ রাতেই বিয়ে দেব।
এই হচ্ছে ঘটনা।
বুঝলেন বাবু সাহেব? চিঠি পড়তে পড়তে আপনার কি আনিস নামের ছেলেটার প্রতি হিংসা হচ্ছিল? হিংসা যাতে হয় এই জন্যেই তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু লিখেছি। ভদ্রলোকের চেহারা আসলেই খালাসির মত।
একটা সত্যি কথা বলি? তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব ছেলেকেই আমার কাছে খালাসির মত মনে হয়। কি এখন খুশীতো?
ইতি–
তোমার আ
দুপুর বারটায় মেইন রোডে গাড়ি রেখে ফরহাদ অফিসে গেল। কান্ট্রি। রিপ্রেজেনটেটিভ অশোক বাবুকে বলবে মফস্বলের আজেবাজে হোটেলে খেয়ে তার ফুড পয়জনিং-এর মত হয়েছে। আজ আর কাল এই দুদিনের ছুটি দরকার। অশোক বাবু ভাল মানুষ ধরনের। তিনি না করবেন না। তাছাড়া সে ছুটিছাটা তেমন নেয় না।
অশোক বাবুকে তার বিয়ের কথাটা বলতে হবে। অনেক দিনতো সে মফস্বলে মফস্বলে ঘুরল এখন যদি তাকে হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়। এতে অবশ্যি তার রোজগার কমে যাবে। টিএ বিল পাবে না। না পাওয়া গেলে নাই। আসমানীর সঙ্গে থাকা এটাই কম কি?
অশোক বাবু ফরহাদের কথা শুনলেন। বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে বললেন—কনগ্রাচুলেশন। ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কি বিয়ে হচ্ছে যে মাঝে মধ্যে আমার টেলিফোনে টেলিফোন করে আপনাকে চাইতো?
ফরহাদ লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।
তাকে একদিন আমি একটু ধমকের মত দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলবেন।
স্যার এটা কোন ব্যাপারই না। আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি—আমাকে ঢাকায় আনার ব্যাপারটা আপনি একটু দেখবেন।
অশোক বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অস্বস্থির সঙ্গে বললেন ফরহাদ সাহেব আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।
ফরহাদ বলল, এইসব নিয়ে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সাহস আমার নেই। যা করবার আপনি করবেন।