এই বলিয়া হরিমোহিনী ধীরে ধীরে আঁচল হইতে কাগজটি খুলিয়া লইয়া তাহার ভাঁজ খুলিয়া সুচরিতার সম্মুখে মেলিয়া দিলেন।
সুচরিতা পড়িল। তাহার যেন নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল। সে কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল।
লেখাটির মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যাহা নূতন বা অসংগত। কথাগুলির সহিত সুচরিতার মতের যে অনৈক্য আছে তাহাও নহে। কিন্তু হরিমোহিনীর হাত দিয়া বিশেষ করিয়া এই লিখনটি তাহাকে পাঠাইয়া দেওয়ার যে অর্থ তাহাই সুচরিতাকে নানাপ্রকারে কষ্ট দিল। গোরার কাছ হইতে এ আদেশ আজ কেন? অবশ্য, সুচরিতারও সময় উপস্থিত হইবে, তাহাকেও একদিন বিবাহ করিতে হইবে–সেজন্য গোরার পক্ষে এত ত্বরান্বিত হইবার কি কারণ ঘটিয়াছে? তাহার সম্বন্ধে গোরার কাজ একেবারে শেষ হইয়া গেছে? সে কি গোরার কর্তব্যে কোনো হানি করিয়াছে, তাহার জীবনের পথে কোনো বাধা ঘটাইয়াছে? তাহাকে গোরার দান করিবার এবং তাহার নিকট প্রত্যাশা করিবার আর কিছুই নাই? সে কিন্তু এমন করিয়া ভাবে নাই। সে কিন্তু এখনো পথ চাহিয়া ছিল। সুচরিতা নিজের ভিতরকার এই অসহ্য কষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু সে মনের মধ্যে কোথাও কিছুমাত্র সান্ত্বনা পাইল না।
হরিমোহিনী সুচরিতাকে অনেকক্ষণ ভাবিবার সময় দিলেন। তিনি তাঁহার নিত্য নিয়মমত একটুখানি ঘুমাইয়াও লইলেন। ঘুম ভাঙিয়া সুচরিতার ঘরে আসিয়া দেখিলেন, সে যেমন বসিয়া ছিল তেমনিই চুপ করিয়া বসিয়া আছে।
তিনি কহিলেন, “রাধু, অত ভাবছিস কেন বল্ দেখি? এর মধ্যে ভাববার অত কী কথা আছে? কেন, গৌরমোহনবাবু অন্যায় কিছু লিখেছেন?”
সুচরিতা শান্তস্বরে কহিল, “না, তিনি ঠিকই লিখেছেন।”
হরিমোহিনী অত্যন্ত আশ্বস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তবে আর দেরি করে কী হবে বাছা?”
সুচরিতা কহিল, “না, দেরি করতে চাই নে, আমি একবার বাবার ওখানে যাব।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “দেখো রাধু, তোমার যে হিন্দুসমাজে বিবাহ হবে এ তোমার বাবা কখনো ইচ্ছা করবেন না, কিন্তু তোমার গুরু যিনি তিনি–”
সুচরিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “মাসি, কেন তুমি বার বার ঐ এক কথা নিয়ে পড়েছ? বিবাহ নিয়ে বাবার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলতে যাচ্ছি নে। আমি তাঁর কাছে অমনি একবার যাব।”
পরেশের সান্নিধ্যই যে সুচরিতার সান্ত্বনার স্থল ছিল।
পরেশের বাড়ি গিয়া সুচরিতা দেখিল, তিনি একটা কাঠের তোরঙ্গে কাপড়চোপড় গোছাইতে ব্যস্ত।
সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, একি!”
পরেশ একটু হাসিয়া কহিলেন, “মা, আমি সিমলা পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছি–কাল সকালের গাড়িতে রওনা হব।”
পরেশের এই হাসিটুকুর মধ্যে মস্ত একটা বিপ্লবের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা সুচরিতার অগোচর রহিল না। ঘরের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী কন্যা ও বাহিরে তাঁহার বন্ধুবান্ধবেরা তাঁহাকে একটুও শান্তির অবকাশ দিতেছিল না। কিছুদিনের জন্যও যদি তিনি দূরে গিয়া কাটাইয়া না আসেন, তবে ঘরে কেবলই তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া একটা আবর্ত ঘুরিতে থাকিবে। কাল তিনি বিদেশে যাইবার সংকল্প করিয়াছেন, অথচ আজ তাঁহার আপনার লোক কেহই তাঁহার কাপড় গুছাইয়া দিতে আসিল না, তাঁহার নিজেকেই এ কাজ করিতে হইতেছে, এই দৃশ্য দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা আঘাত লাগিল। সে পরেশবাবুকে নিরস্ত করিয়া প্রথমে তাঁহার তোরঙ্গ সম্পূর্ণ উজাড় করিয়া ফেলিল। তাহার পরে বিশেষ যত্নে ভাঁজ করিয়া কাপড়গুলিকে নিপুণহস্তে তোরঙ্গের মধ্যে আবার সাজাইতে লাগিল, এবং তাঁহার সর্বদাপাঠ্যবই-গুলিকে এমন করিয়া রাখিল যাহাতে নাড়াচাড়াতেও তাহাদের আঘাত না লাগে। এইরূপে বাক্স গুছাইতে গুছাইতে সুচরিতা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা তুমি কি একলাই যাবে?”
পরেশ সুচরিতার এই প্রশ্নের মধ্যে বেদনার আভাস পাইয়া কহিলেন, “তাতে আমার তো কোনো কষ্ট নেই রাধে!”
সুচরিতা কহিল, “না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব।”
পরেশ সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন। সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে কিছু বিরক্ত করব না।”
পরেশ কহিলেন, “সে কথা কেন বলছ? আমাকে তুমি কবে বিরক্ত করেছ মা?”
সুচরিতা কহিল, “তোমার কাছে না থাকলে আমার ভালো হবে না বাবা। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নে। তুমি আমাকে বুঝিয়ে না দিলে আমি কিনারা পাব না। বাবা, তুমি যে আমাকে আমার নিজের বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে বল–আমার সে বুদ্ধি নেই, আমি মনের মধ্যে সে জোরও পাচ্ছি নে। তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো বাবা!”
এই বলিয়া সে পরেশের দিকে পিঠ করিয়া অত্যন্ত নতশিরে তোরঙ্গের কাপড় লইয়া পড়িল। তাহার চোখ দিয়া টপ্ টপ্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
গোরা ৭৫
৭৫
গোরা লিখনটি লিখিয়া যখন হরিমোহিনীর হাতে দিল তখন তাহার মনে হইল সুচরিতা সম্বন্ধে সে যেন ত্যাগপত্র লিখিয়া দিল। কিন্তু দলিল লিখিয়া দিলেই তো তখনই কাজ শেষ হয় না। তাহার হৃদয় যে সে দলিলকে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিল। সে দলিলে কেবল গোরার ইচ্ছাশক্তি জোর কলমে নামসই করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হৃদয়ের স্বাক্ষর তো তাহাতে ছিল না–হৃদয় তাই অবাধ্য হইয়াই রহিল। এমনি ঘোরতর অবাধ্যতা যে, সেই রাত্রেই গোরাকে একবার সুচরিতার বাড়ির দিকে দৌড় করাইয়াছিল আর-কি! কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই গির্জার ঘড়িতে দশটা বাজিল এবং গোরার চৈতন্য হইল এখন কাহারো বাড়িতে গিয়া দেখা করিবার সময় নয়। তাহার পরে গির্জার প্রায় সকল ঘড়িই গোরা শুনিয়াছে। কারণ বালির বাগানে সে রাত্রে তাহার যাওয়া ঘটিল না। পরদিন প্রত্যুষে যাইবে বলিয়া সংবাদ পাঠাইয়াছে।