“কিন্তু বাপু, তোমাকে আমি খুলেই বলি, ও মেয়ে তোমার যোগ্য নয়। পাড়াগাঁয়ে ওর বিয়ে হলে ওর কথা কেউ জানতেই পারবে না; সে একরকম করে চলে যাবে। কিন্তু তোমরা শহরে থাক, ওকে যদি বিয়ে কর তা হলে শহরের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।”
গোরা ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনি এ-সব কথা কী বলছেন! কে আপনাকে বলেছে যে, আমি তাঁকে বিবাহ করবার জন্যে তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছি!”
হরিমোহিনী কহিলেন, “আমি কী করে জানব বাবা! কাগজে বেরিয়ে গেছে সেই শুনেই তো লজ্জায় মরছি।”
গোরা বুঝিল, হারানবাবু, অথবা তাঁহার দলের কেহ এই কথা লইয়া কাগজে আলোচনা করিয়াছে। গোরা মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা!”
হরিমোহিনী তাহার গর্জনশব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আমিও তো তাই জানি। এখন আমার একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতেই হবে। একবার তুমি রাধারানীর কাছে চলো।”
গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”
হরিমোহিনী কহিলেন, “তুমি তাকে একবার বুঝিয়ে বলবে।”
গোরার মন এই উপলক্ষটি অবলম্বন করিয়া তখনই সুচরিতার কাছে যাইবার জন্য উদ্যত হইল। তাহার হৃদয় বলিল, “আজ একবার শেষ দেখা দেখিয়া আসিবে চলো। কাল তোমার প্রায়শ্চিত্ত–তাহার পর হইতেই তুমি তপস্বী। আজ কেবল এই রাত্রিটুকুমাত্র সময় আছে–ইহারই মধ্যে কেবল অতি অল্পক্ষণের জন্য। তাহাতে কোনো অপরাধ হইবে না। যদি হয় তো কাল সমস্ত ভস্ম হইয়া যাইবে।’
গোরা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তাঁকে কী বোঝাতে হবে বলুন।”
আর কিছু নয়–হিন্দু আদর্শ-অনুসারে সুচরিতার মতো বয়স্থা কন্যার অবিলম্বে বিবাহ করা কর্তব্য এবং হিন্দুসমাজে কৈলাসের মতো সৎপাত্রলাভ সুচরিতার অবস্থার মেয়ের পক্ষে অভাবনীয় সৌভাগ্য।
গোরার বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধিতে লাগিল। যে লোকটিকে গোরা সুচরিতার বাড়ির দ্বারের কাছে দেখিয়াছিল তাহাকে স্মরণ করিয়া গোর বৃশ্চিক-দংশনে পীড়িত হইল। সুচরিতাকে সে লাভ করিবে এমন কথা কল্পনা করাও গোরার পক্ষে অসহ্য। তাহার মন বজ্রনাদে বলিয়া উঠিল, “না, এ কখনোই হইতে পারে না!’
আর-কাহারো সঙ্গে সুচরিতার মিলন হওয়া অসম্ভব; বুদ্ধি ও ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ সুচরিতার নিস্তব্ধ গভীর হৃদয়টি পৃথিবীতে গোরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষের সামনে এমন করিয়া প্রকাশিত হয় নাই এবং আর-কাহারো কাছে কোনোদিনই এমন করিয়া প্রকাশিত হইতে পারে না। সে কী আশ্চর্য! সে কী অপরূপ! রহস্যনিকেতনের অন্তরতম কক্ষে সে কোন্ অনির্বচনীয় সত্তাকে দেখা গেছে! মানুষকে এমন করিয়া কয়বার দেখা যায় এবং কয়জনকে দেখা যায়! দৈবের যোগেই সুচরিতাকে যে ব্যক্তি এমন প্রগাঢ় সত্যরূপে দেখিয়াছে, নিজের সমস্ত প্রকৃতি দিয়া তাহাকে অনুভব করিয়াছে, সেই তো সুচরিতাকে পাইয়াছে। আর-কেহ আর-কখনো তাহাকে পাইবে কেমন করিয়া?’
হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানী কি চিরদিন এমনি আইবুড়ো থেকে যাবে! এও কি কখনো হয়!”
সেও তো বটে। কাল যে গোরা প্রায়শ্চিত্ত করিতে যাইতেছে। তাহার পরে সে যে সম্পূর্ণ শুচি হইয়া ব্রাহ্মণ হইবে। তবে সুচরিতা কি চিরদিন অবিবাহিতই থাকিবে? তাহার উপরে চিরজীবনব্যাপী এই ভার চাপাইবার অধিকার কাহার আছে! স্ত্রীলোকের পক্ষে এতবড়ো ভার আর কী হইতে পারে!
হরিমোহিনী কত কী বকিয়া যাইতে লাগিলেন। গোরার কানে তাহা পৌঁছিল না। গোরা ভাবিতে লাগিল, “বাবা যে এত করিয়া আমাকে প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করিতে নিষেধ করিতেছেন, তাঁহার সে নিষেধের কি কোনো মূল্য নাই? আমি আমার যে জীবন কল্পনা করিতেছি সে হয়তো আমার কল্পনামাত্র, সে আমার স্বাভাবিক নয়। সেই কৃত্রিম বোঝা বহন করিতে গিয়া আমি পঙ্গু হইয়া যাইব। সেই বোঝার নিরন্তর ভারে আমি জীবনের কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন করিতে পারিব না। এই-যে দেখিতেছি আকাঙক্ষা হৃদয় জুড়িয়া রহিয়াছে। এ পাথর নড়াইয়া রাখিব কোন্খানে! বাবা কেমন করিয়া জানিয়াছেন অন্তরের মধ্যে আমি ব্রাহ্মণ নই, আমি তপস্বী নই, সেইজন্যই তিনি এমন জোর করিয়া আমাকে নিষেধ করিয়াছেন।’
গোরা মনে করিল, “যাই তাঁর কাছে। আজ এখনই এই সন্ধ্যাবেলাতেই আমি তাঁহাকে জোর করিয়া জিজ্ঞাসা করিব তিনি আমার মধ্যে কী দেখিতে পাইয়াছেন। প্রায়শ্চিত্তের পথও আমার কাছে রুদ্ধ এমন কথা তিনি কেন বলিলেন? যদি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারেন তবে সে দিক হইতে ছুটি পাইব–ছুটি।’
হরিমোহিনীকে গোরা কহিল, “আপনি একটুখানি অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসছি।”
তাড়াতাড়ি গোরা তাহার পিতার মহলের দিকে গেল। তাহার মনে হইল, কৃষ্ণদয়াল এখনই তাহাকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন এমন একটা কথা তাঁহার জানা আছে।
সাধনাশ্রমের দ্বার বদ্ধ। দুই-এক বার ধাক্কা দিল, খুলিল না–কেহ সাড়াও দিল না। ভিতর হইতে ধূপধুনার গন্ধ আসিতেছে। কৃষ্ণদয়াল আজ সন্ন্যাসীকে লইয়া অত্যন্ত গূঢ় এবং অত্যন্ত দুরূহ একটি যোগের প্রণালী সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিয়া অভ্যাস করিতেছেন–আজ সমস্ত রাত্রি সে দিকে কাহারো প্রবেশ করিবার অধিকার নাই।
গোরা ৭৪
৭৪
গোরা কহিল–“না। প্রায়শ্চিত্ত কাল না। আজই আমার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হয়েছে। কালকের চেয়ে ঢের বড়ো আগুন আজ জ্বলেছে। আমার নবজীবনের আরম্ভে খুব একটা বড়ো আহুতি আমাকে দিতে হবে বলেই বিধাতা আমার মনে এতবড়ো একটা প্রবল বাসনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কেন? আমি ছিলুম কোন্ ক্ষেত্রে! এদের সঙ্গে আমার মেলবার কোনো লৌকিক সম্ভাবনা ছিল না। আর এমন বিরুদ্ধভাবের মিলনও পৃথিবীতে সচরাচর ঘটে না। আবার সেই মিলনে আমার মতো উদাসীন লোকের চিত্তেও যে এতবড়ো দুর্জয় একটা বাসনা জাগতে পারে সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। ঠিক আজই আমার এই বাসনার প্রয়োজন ছিল। আজ পর্যন্ত আমি দেশকে যা দিয়ে এসেছি তা অতি সহজেই দিয়েছি, এমন দান কিছু করতে হয় নি যাতে আমাকে কষ্টবোধ করতে হয়েছে। আমি ভেবেই পেতুম না, লোকে দেশের জন্যে কোনো জিনিস ত্যাগ করতে কিছুমাত্র কৃপণতা বোধ করে কেন। কিন্তু বড়ো যজ্ঞ এমন সহজ দান চায় না। দুঃখই চাই। নাড়ী ছেদন করে তবে আমার নবজীবন জন্মগ্রহণ করবে। কাল প্রাতে জনসমাজের কাছে আমার লৌকিক প্রায়শ্চিত্ত হবে। ঠিক তার পূর্বরাত্রেই আমার জীবনবিধাতা এসে আমার দ্বারে আঘাত করেছেন। অন্তরের মধ্যে আমার অন্তরতম প্রায়শ্চিত্ত না হলে কাল আমি শুদ্ধি গ্রহণ করব কেমন করে! যে দান আমার পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন দান সেই দান আমার দেবতাকে আজ সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়ে তবেই আমি সম্পূর্ণ পবিত্ররূপে নিঃস্ব হতে পারব–তবেই আমি ব্রাহ্মণ হব।’