ওসমান বললেন, না।
খালি পেটে কমলার রস খাওয়া যাবে না, এসিডিটি হবে। আপনার ঘরে বিসকিট নাই, বিসর্কিট নিয়ে আসি।
বিসকিট তোমাকে আনতে যেতে হবে না। রফিক খাবার নিয়ে আসবে। তাকে দিয়ে আনলেই হবে।
সে কখন খাবার আনে?
আটটার মধ্যে সব সময় আসে।
মনিকা বলল, আটটা দশ কিন্তু বাজে। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ওসমান বললেন, ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লোন-টর্নেডো যাই হোক রফিক আসবে। কারণ, রফিক জানে সে যদি না আসে আমাকে উপোষ থাকতে হবে।
আপনার ঘরে কি মোমবাতি আছে?
আছে। ড্রয়ারে আছে। কেন?
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। আমি আগেভাগেই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতে চাই।
তুমি খুবই গোছানো মেয়ে।
আপনার মতো গোছানো না।
ওসমান বললেন, আমাকে গোছানো হতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। মনিকা শোনো, তুমি আমার creative writing-এর উপর কিছু বইপত্র জোগাড় করে দিতে পারবে।
কী করবেন? আমি ঠিক করেছি একটা উপন্যাস লিখব। একসঙ্গে কত কিছু করবেন?
কোনোটাই তো ক্লিক করছে না। তবে গল্প-উপন্যাস মনে হয় লিখতে পারব। আমি খুব গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারতাম।
পারতাম বলছেন কেন? এখন পারেন না?
অনেক দিন কাউকে চিঠি লিখি না, কাজেই বলতে পারছি না পারব কি-না।
কাউকে লিখে দেখুন।
ওসমান বললেন, চিঠি লেখার আমার তেমন কেউ নেই, তোমাকে লিখব?
মনিকা বলল, লিখতে পারেন।
কী লিখব?
মনিকা বলল, কী লিখবেন সেটা আপনি জানেন। আমি কীভাবে বলব। আপনার রফিক কিন্তু এখনও আসে নি।
ওসমান বললেন, চলে আসবে। তুমি বরং কমলার রসটা দাও। আমি খেয়ে নেই। কমলার রস না খাওয়া পর্যন্ত তোমার অস্থিরতা কমবে না। আমার এসিডিটির কোনো সমস্যা নেই। কাজেই অসুবিধা হবে না।
কমলার রস খাবার মাঝখানে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ওসমান স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। বাল্বের আলো চোখে লাগছিল, এখন আরাম লাগছে। মোমবাতির আলো চোখে আরাম দেয়।
মনিকা! কাগজ-কলম নিয়ে বসো তো। চিঠি লিখব। মুখে-মুখে বলে যাব তুমি লিখবে।
চিঠিটা কি আমাকেই লিখবেন?
হুঁ। লেখো হ্যালো মনিকা।
হ্যালো মনিকা কেন লিখব? আপনি তো আমাকে টেলিফোন করছেন না। চিঠি লিখছেন।
ইন্টারেস্টিং করার জন্যে হ্যালো মনিকা দিয়ে শুরু করেছি। তুমি লিখতে থাকো।
হ্যালো মনিকা।
তুমি এখন আমাকে কালার হুইল শেখাচ্ছ। ছবিতে রঙ বসাতে হবে কালার হুইল দেখে। যেন রঙে রঙে মিল থাকে। চোখে না লাগে। আমার কথা হচ্ছে প্রকৃতি কি রঙের ব্যাপারে কালার হুইল ব্যবহার করে? সূর্যাস্তগুলি আমি কিছুদিন হলো খুব মন দিয়ে দেখছি। সেখানে কালার হুইলের কোনো ব্যাপার নেই, হালকা ফিরোজা রঙের পাশেই গাঢ় খয়েরি।…
আপনি দ্রুত বলছেন, আমি এত দ্রুত লিখতে পারছি না।
সরি। তুমি কোন পর্যন্ত লিখেছ?
আমি অনেক পেছনে। আমি লিখেছি–সূর্যাস্তগুলি আমি কিছুদিন… তারপর কী, আমি ভুলে গেছি।
মনিকা জ্বরটা কি আরেকবার দেখবে? মনে হয় বেড়েছে।
মনিকা জ্বর মাপল ১০৪.৫°, ওসমান বললেন, থার্মোমিটার নষ্ট না তো? জ্বর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এটা অস্বাভাবিক না?
মনিকা বলল, থার্মোমিটার ঠিক আছে। স্যার আপনার রফিক এখনও আসে নি।
ওসমান বললেন, চলে আসবে। চলে আসবে।
জ্বরের ঘোরে চলে আসবে বাক্য মাথায় ঢুকে গেল। গ্রামোফোনের পিন আটকে যাবার মতো ক্রমাগত চলে আসবে চলে আসবে হচ্ছে।
মনিকা বলল, স্যার আমাকে চলে যেতে হবে। দশটার সময় হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে যায়।
ওসমান বললেন, চলে আসবে। রফিক চলে আসবে।
মনিকা বলল, আপনাকে একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। এখন ডাক্তার কোথায় পাব।
ওসমান বললেন, ডাক্তার চলে আসবে।
মনিকা বলল, আপনার কোনো রিলেটিভকে টেলিফোন করলে আসবে না? আপনার পাশে কাউকে থাকা দরকার।
ওসমান বললেন, চলে আসবে। সবাই চলে আসবে।
মনিকা উঠে দাঁড়াল। দোতলার কাউকে পাওয়া গেলে খবর দেবে। তার নিজের ইচ্ছে করছে থেকে যেতে। অসুস্থ মানুষের জন্যে থেকে যাওয়া অন্যায় কিছু না। কিন্তু থাকা সম্ভব না।
ইলেকট্রিসিটি নেই, কাজেই কলিং বেল কাজ করছে না। অভ্যাসের কারণে মনিকা কলিং বেলের বোতাম চেপেই যাচ্ছে। কলিং বেল চাপাচাপির মধ্যেই কারেন্ট চলে এলো। দরজা খুলল তরু। সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, ভেতরে আসুন।
মনিকা বলল, ভেতরে আসব না। আমার নাম মনিকা।
আপনাকে চিনি। আপনি চাচাকে ছবি আঁকা শেখান। আপনার সঙ্গে একদিন আমার কথাও হয়েছে।
ও হ্যাঁ, কথা হয়েছিল। আপনার নাম মিস্ট্রি।
ভেতরে এসে বসুন। দরজায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কথা বলবেন।
আমি চলে যাব। আমাদের হোস্টেলের গেট দশটার সময় বন্ধ করে দেয়। একটা খবর দিতে এসেছিলাম—ওসমান স্যারের শরীর খুব খারাপ করেছে। প্রচণ্ড জ্বর, একশ চার।
তরু বলল, একশ চার পয়েন্ট পাঁচ হবার কথা।
মনিকা বিস্মিত হয়ে বলল, হ্যাঁ তাই।
তরু বলল, চাচার থার্মোমিটারটা নষ্ট। জ্বর যতই হোক এই থার্মোমিটারে উঠবে একশ চার পয়েন্ট ফাইভ। তারপরেও আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমি লোক পাঠাচ্ছি। সনজু বলে একটা ছেলে আছে, সে প্রয়োজন হলে রাতে উনার সঙ্গে থাকবে।
মনিকা বলল, থ্যাংক ইউ। আপনার কাছে কি ভালো থার্মোমিটার আছে? আসল জ্বরটা কত দেখতাম।
তরু থার্মোমিটার বের করে দিল। মনিকা উঠে গেল ছাদে।
ওসমান দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছেন। রফিক এসেছে। টিফিন কেরিয়ারের বাটি সাজাচ্ছে।
ওসমান বললেন, তুমি এখনও যাও নি।