প্রেমিক না। তাহলে আমি কেন ভিজছি?
তুমি এসো করো স্নান নামে একটা উপন্যাস লিখছ এই জন্যেও বৃষ্টিতে ভিজছ।
হয়েছে। তবে উপন্যাসের নাম এখনো ফাইনাল হয় নি। যে পাঁচ পৃষ্ঠা আপনাকে দিয়েছি, পড়েছেন?
হ্যাঁ।
কেমন হয়েছে?
কেমন হয়েছে বলা আমার পক্ষে মুশকিল। একজন ঔপন্যাসিক সেটা বলতে পারবেন। যিনি তোমাকে উপন্যাস লেখার কলাকৌশল শিখিয়েছেন তাকে পড়তে দাও।
অসম্ভব। ঐ বাড়িতে যাওয়াই যাবে না।
কেন?
ঔপন্যাসিকের স্ত্রী অত্যন্ত সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মহিলা। আমি যতক্ষণ ছিলাম তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় বলেই ফেললেন, তুমি হুট হুট করে আসবে না। উনি লেখালেখি করেন। ব্যস্ত থাকেন। সামনেই বইমেলা। আমি বললাম, আমি কি টেলিফোনে কথা বলতে পারি? ভদ্রমহিলা প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, কখনও টেলিফোন করবে না। ও কখনও টেলিফোন ধরে না। কেউ টেলিফোনে কথা বলতে চাইলে অত্যন্ত বিরক্ত হয়। এরপরেও কি ঐ বাড়িতে আমার যাওয়া উচিত?
না।
একজন পাঠক হিসাবে বলুন কেমন লেগেছে?
লেখায় গল্পের ভঙ্গিটা ভালো। তবে এই হচ্ছে আমার টেলিফোন নাম্বার, লেখা ভালো লাগলে যোগাযোগ করবেন অংশ ভালো লাগে নি।
কেন?
এই অংশে ছেলেমানুষি আছে তাই।
ছেলেমানুষি করার জন্যেই তো আমি ঐ অংশটা রেখেছি। ঐ টেলিফোন নাম্বার মোটেই আমার নাম্বার না। বানানো নাম্বার। আনা ফ্রাংকের ডায়েরি থেকে আপনি যদি ছেলেমানুষি অংশটা ফেলে দেন তাহলে ডায়েরি পড়তে ভালো লাগবে না।
তুমি আনা ফ্রাংকের ডায়েরি পড়েছ?
হুঁ। টিউটরিয়েল স্যার পড়তে দিয়েছিলেন। উনার নিক নেম চর্যা স্যার। চর্যাপদ পড়ান বলেই এই নাম। আনা ফ্রাংক পড়ে শেষ করে চর্যা স্যারকে ফিরত দিতে গিয়েছি। স্যার বললেন, রেখে দাও, ফেরত দিতে হবে না।
ভালো মানুষ মনে হচ্ছে।
হুঁ ভালো মানুষ—-আমার দিকে প্রেম প্রেম ভাব আছে বলে মনে হয়। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব।
আমার সঙ্গে পরিচয় করিতে দেবে কেন?
মানুষের সঙ্গেই তো মানুষ পরিচয় করে। উনার সঙ্গে গল্প করলে আপনার ভালো লাগবে। উনি সুন্দর করে কথা বলেন। কথা বললে দারুণ আনন্দ পাবেন।
ওসমান বললেন, আপাতত এক কাপ চা খেতে পারলে দারুণ আনন্দ পাব। তুমি চা বানিয়ে দিতে পারবে?
না। এখন পারব না। বৃষ্টিতে ভেজা শেষ হলে আমি ঘরে চলে যাব। কাজের মেয়েকে দিয়ে চা পাঠাব। দশ মিনিট পরে চা খেলে আপনার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। না-ক্ষতি হবে?
ক্ষতি হবে না। আচ্ছা আমার লেখা পড়ে সুতা কৃমির প্রতি কি মমতা তৈরি হয়েছে?
না। কাপুরুষতা মমতা তৈরি করে না। শেক্সপিয়রের ঐ লাইনটা কখনও পড়েছ? Coward dies many times before their death.
না, পড়ি নি। সুন্দর লাইন তো। বাংলায় কী হবে? ভীতুরা মৃত্যুর আগেই অনেক বার মারা যায়। চাচা বাংলাটা ইংরেজির মতো সুন্দর লাগছে না কেন?
ওসমান ডান হাত থেকে বাঁ হাতে ছাতা বদল করতে করতে বললেন, ভীতু শব্দটার জন্যে। Coward শব্দের বাংলা ভীতু হবে না। যে মাকড়সা ভয় পায় সেও ভীতু। কিন্তু Coward শব্দ তার জন্যে না।
চাচা আপনার কি ধারণা আপনি খুব জ্ঞানী?
তা না। প্রচুর পড়ি তো, এই কারণেই হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা জ্ঞানের কথা বলে ফেলি।
আর বলবেন না। আপনি জ্ঞানের কথা বললে আমার অসহ্য লাগে।
আচ্ছা আর বলব না। তোমার মনে হয় ঠাণ্ডা লেগে গেছে। শীতে কাঁপছ।
আমি চাচ্ছি আরো ঠাণ্ডা লাগুক। জ্বর আসুক। জ্বর নিয়ে লেপের ভেতর শুয়ে থাকতে আমার খুবই ভালো লাগে।
তাহলে আরও ভেজ।
বেশিক্ষণ ভিজতে পারব না। দেখুন আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। বৃষ্টির তেজও কমে গেছে। আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। দশ মিনিটের মাথায় আপনার চা চলে আসবে।
তরু শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে গেল। মনে হয় বৃষ্টিটা তরুর জন্যেই এসেছিল। সে চলে যাওয়া মাত্র বৃষ্টি পুরাপুরি থেমে গেল। ওসমান অনেকক্ষণ চায়ের জন্যে অপেক্ষা করলেন। কেউ চা নিয়ে এলো না। তিনি নিজেই কফি বানিয়ে খেলেন। বৃষ্টির কারণে রুটিন খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেল। রুটিন মতো এখন ছবি আঁকার কথা। ছবি আঁকতে ইচ্ছা করছে না। লেপ গায়ে দিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করতে ইচ্ছা করছে। তরুর কথা মাথায় ঢুকে গেছে। একে বলে Sympathetic reaction. তরু চাচ্ছিল তার জ্বর আসুক, সে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকবে। তিনিও তাই চাচ্ছেন। তরুকে নিয়ে তার কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে কি-না কে জানে।
সন্ধ্যা নাগাদ সত্যি সত্যি তার জ্বর এসে গেল। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর। ওসমান নিজেকে বিছানায় তুললেন। হুইল চেয়ার থেকে বিছানায় ওঠার প্রক্রিয়া কষ্টকর। অনেক সময় লাগে। পায়ের কাছে রাখা কম্বলে শরীর ঢাকলেন। কম্বলে শীত মানছে না। লেপ হলে ভালো হতো। লেপ ট্রাংকে রাখা। ঘরে থার্মোমিটার আছে। রান্নাঘরে মেডিসিন ক্যাবিনেটে। থার্মোমিটার আনতে হলে আবার বিছানা থেকে হুইল চেয়ারে উঠতে হয়। কী দরকার? সন্ধ্যাবেলা মনিকা আসবে। সে-ই থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখবে।
মনিকা এসেছে। জ্বর মেপেছে। তাঁর জ্বর ১০৪.৫° কিংবা তার চেয়ে সামান্য বেশি। মনিকা গম্ভীর মুখে তার গা স্পঞ্জ করে দিচ্ছে। মেডিসিন ক্যাবিনেটে প্যারাসিটামল ছিল, প্যারাসিটামল খাইয়েছে। দোকান থেকে অরেঞ্জ জুস কিনে এনে গ্লাসে ঢেলে রেখেছে।
মনিকা বলল, স্যার, সকালে নাশতা ছাড়া আপনি আর কিছু খেয়েছেন?