জামান ভাই এখন কি বলছেন?
কী আর বলবে। কিছু বলছে না। গম্ভীর হয়ে আছে।
সরি তো বলবে।
আশ্চর্য কথা বললে। তোমার ভাই কি সরি বলার মানুষ। টাকা পাওয়া। গেছে এতেই সে খুশি।
সুতা কৃমি তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে স্বাভাবিকভাবে বাজার সদাই করা শুরু করল। কলেজে যাওয়া শুরু করল, যেন কিছুই হয় নি। আজ এই পর্যন্ত লিখলাম। কারণ আঠারোটা মোমবাতির এগারোটা শেষ হয়ে নিভে গেছে। বাকি সাতটাও যাই যাই করছে। কাজেই প্রিয় পাঠক সমাজ বিদায়।
তরুর লেখা এইটুকুই। আসল ঘটনা সে লেখায় বাদ দিয়েছে। উপন্যাসের শেষের দিকে আসলটা লিখবে। পাঠকদের জন্যে সাসপেন্স জমা থাকুক। একটা ছোট্ট সমস্যা অবিশ্য থাকবে—পাঠকরা বিশ হাজার টাকা চুরির ঘটনা ভুলে যেতে পারে। সবার স্মৃতিশক্তি তো আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো না যে, যা পড়বে সবই মনে থাকবে।
মূল ঘটনা হচ্ছে সুতা কৃমি বিশ হাজার টাকা ঠিকই চুরি করেছিল। এক দুপুর বেলায় তরুদের বাসায় ঘন ঘন কলিং বেল টিপছে। তার মুখে ঘাম। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। মুখ কাঁদো কাঁদো।
তরু বলল, কী সমস্যা?
সে ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে বলল, এই প্যাকেটটা রাখবেন?
তরু বলল, প্যাকেটে কি বোমা, না-কি পিস্তল?
টাকা। একশ টাকার দুটা বান্ডেল।
টাকা রাখব কেন? কার টাকা?
দুলাভাইয়ের।
তোমার দুলাভাইয়ের টাকা থাকবে তোমার কাছে কিংবা তোমার বোনের কাছে। আমার কাছে কেন?
সনজুর চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তরু লক্ষ করল তার হাত কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে টাকার বান্ডেল হাত থেকে পড়ে যাবে।
তরু বলল, টাকাটা কি তুমি চুরি করেছ?
সনজু অন্য দিকে তাকিয়ে হাসূচক মাথা নাড়ল।
তরু বলল, ঝেড়ে কাশতে হবে। খুকখুক করে কাশলে হবে না। ঘটনা কী বলো?
আমি পালিয়ে যাব।
কোথায়?
টেকনাফে আমার এক বন্ধু আছে। কাঠ চিড়াই কলে কাজ করে। তার কাছে যাব।
বন্ধুর নাম কী?
এনামুল করিম।
পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাঠ চেড়াই?
দুলাভাইয়ের কাছে থাকতে পারছি না। তিন মাসের কলেজের বেতন বাকি পড়েছে। কলেজে নাম কাটা গেছে। এই বিশ হাজার টাকা নিয়ে আমি পালিয়ে যাব।
তরু প্যাকেট রেখে দরজা বন্ধ করে দিল। মারামারির মূল ঘটনার পর জামান এবং তার স্ত্রী যখন সনজুকে নিয়ে হাসপাতালে তখন তরু টাকার প্যাকেট খাটের নিচে রেখে এসেছে।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর কয়েক বারই তরুর সাথে সনজুর দেখা হয়েছে। সনজু টাকার প্রসঙ্গ তুলে নি। তরুও না।
গতকাল তরু সনজুকে একটা সিএনজি ডেকে দিতে বলল। সনজু সিএনজি ডেকে দিল। তরু বলল, লক্ষ করলাম কলেজে যাচ্ছ।
সনজু বলল, হুঁ।
নাম যে কাটা গিয়েছিল, নাম কি উঠেছে?
উঠেছে।
তোমার দুলাভাই বেতনের টাকা দিয়েছেন?
আপা দিয়েছেন।
উনি কোত্থেকে দেবেন? উনার কি আলাদা টাকা আছে?
না। মনে হয় দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে দিয়েছেন।
তোমার বন্ধু এনামুল করিম কেমন আছে?
জানি না।
যোগাযোগ নাই?
না।
তার কি কোনো মোবাইল টেলিফোন আছে?
আছে।
নাম্বার জানা আছে?
আছে। আমার মোবাইলটা নিয়ে তার কাছে টেলিফোন করতে পারো।
দরকার নাই।
তরু হালকা গলায় বলল, তোমার দুলাভাইকে খুন করার কোনো পরিকল্পনা যদি করো, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমার এক বান্ধবী আছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ওর নাম নীলা। ওকে বললেই সে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করে দিবে। তুমি তোমার দুলাভাইয়ের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। পারবে না?
না।
তারপরও আমি জোগাড় করে রাখব। সব ব্যবস্থা করা থাকবে। আমাকে বললেই হবে। ঠিক আছে?
সনজু তাকিয়ে রইল। তার সামান্য ভয় করতে লাগল। এই অদ্ভুত মেয়েটা এসব কি বলছে? ঠাট্টা করছে? না-কি সিরিয়াস? ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস। সনজুর কপাল ঘেমে উঠল।
ঢাকা শহরে বৃষ্টি
ঢাকা শহরে বৃষ্টি। ওসমান ছাদে। এক হাতে মাথায় ছাতি ধরে আছেন। ঝুমঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। তাঁর ভালো লাগছে। গরম এক মগ কফি যদি কেউ তার হাতে ধরিয়ে দিত আরো ভালো লাগত। কয়েক দিন আগে একটা ছবিতে এ রকম দৃশ্য দেখেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় এক যুবক বসে আছে। তুষারপাত হচ্ছে। যুবকের হাতে মস্ত বড় এক কফি মগ কফির ধুয়া উঠছে। যুবক কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এক ধরনের বিষণ্ণ আনন্দ নিয়ে তুষারপাত দেখছে। কফির কাপে চুমুক দেবার আগে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাপের দিকে তাকাচ্ছে। যেন কাপের ভিতর সে কিছু দেখতে পাচ্ছে। পরিচালক ভালো মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কফির কাপের ভেতরটার জন্যে দর্শকদের আগ্রহ তৈরি করেছেন।
তাঁর হাতে চায়ের কাপ থাকলে তিনিও এই কাজটা করতেন। কিছুক্ষণ তাকাতেন মগের ভেতরে। কিছুক্ষণ আকাশে। নিজেকে পর্বতারোহী ভেবে অন্যের জীবনযাপন করতেন। এটা এক ধরনের খেলা। পঙ্গু মানুষকে জীবনযাপন করতে হলে কিছু খেলা খেলতে হয়। যেমন—অভিনয় অভিনয় খেলা। ছবি আঁকাআঁকি খেলা। আকাশের তারা দেখা খেলা। নিজেকে সান্তুনা দেয়া–আমার জীবন হুইল চেয়ারে আইকা গাম দিয়ে কেউ আটকে দেয় নি। আমি পৰ্বতে উঠতে পারি। তুষারপাত দেখতে পারি। জলরঙ দিয়ে গহিন বনের ছবি এঁকে সেই বনে ঢুকে যেতে পারি।
চাচা কী করছেন?
তরু ছাদে এসেছে। মাথায় ছাতা-টাতা কিছু নেই। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসমান বললেন, বৃষ্টিতে ভিজছি।
তরু বলল, আপনি ছাতার নিচে বসে আছেন। আপনি মোটেই বৃষ্টিতে ভিজছেন না। বৃষ্টিতে আমি ভিজছি। এখন বলুন কেন? আমি মোটেই বৃষ্টি